Wednesday, March 3, 2010

শৈলীবিষয়ক কথকতা


আরবি ক্যালিগ্রাফির প্রাথমিক শৈলীগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, সে সময়ের গবেষক, কাতিব, ক্যালিগ্রাফার বা খাত্তাতদের কাজগুলো কোন শৈলীতে করা হয়েছিল তার একটা স্পষ্ট ধারণা হয়ত আমরা পেতে পারি। কাতিব ও খাত্তাত সম্পর্কে প্রথমে খোলাশা হওয়া প্রয়োজন। কাতিব হচ্ছেন যিনি আরবি লিপিগুলো যথাযথ লিখতে পারেন এবং কিতাব লেখার কাজে পেশাদার হিসেবে কাজ করেন। কাতিব শুধু লেখার কাজটি করেন। খাত্তাত বা ক্যালিগ্রাফার যিনি একাধারে কাতিব ও শৈলীগুলোর সূক্ষ্ম পার্থক্য নিরূপণ করে ছাত্রদের শেখাতে পারেন। নুতন শৈলী আবিষ্কার ও তাতে উন্নয়ন ঘটান, পুরাতন শৈলীতে উন্নয়নের প্রয়াস চালান। যুখরুফাহ আল আরাবিয়া বা নক্সাকলা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখেন। বই বাধাই, বই সংরক্ষণ, বিপণনসহ ক্যালিগ্রাফির যাবতীয় বিষয়ে জ্ঞান রাখেন। এজন্য একজন ক্যালিগ্রাফারের অধীনে বহু কাতিব, নক্সাকার, বাঁধাইকার চাকরি করতেন। এমনকি সেসময় দেশের বড় বড় গ্রন্থাগারের পরিচালক যেমন ক্যালিগ্রাফার ছিলেন। প্রশাসনিক বড় বড় পদেও ক্যালিগ্রাফারকে নিয়োগ দেয়া হতো। কারণ প্রশাসনের উচ্চপদে সৃজনশীল লোকদের নিয়োগ দেয়াটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হত। ক্যালিগ্রাফারগণের প্রত্যেকেই ক্যালিগ্রাফির উন্নয়নে গ্রন্থ রচনা করেছেন। ইতিহাসে এমন কোন ক্যালিগ্রাফার পাওয়া যাবে না যে, তিনি কোন ক্যালিগ্রাফিবিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেননি। ক্যালিগ্রাফির জনক বলে খ্যাত ইবনে মূকলাহ (মৃ. ৯৪০ খৃ.) থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ের নামকরা ক্যালিগ্রাফার বুরসাঈদী পর্যন্ত সমস্ত মাস্টার ক্যালিগ্রাফারই এরকম অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেমন আলী ইবনে হিলাল ইবনে বাওয়াব (মৃ. ১০২২ খৃ.) একটি চমৎকার গ্রন্থ রচনা করেন, যার নাম হচ্ছে “মানসুব আল ফায়েক”, তিনি ক্যালিগ্রাফির বিভিন্ন ধারা, ইস্টালের ওপর মূল সূত্রগুলো রচনা করেন, ইবনে বাওয়াব বলেন, এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে কেউ কোন যাদুর মত বা হুট করে এই শিল্প আয়ত্ত করে চমক দেখাবে। এটা একমাত্র নিরন্তর অনুশীলন, চর্চা ও সঠিক নিয়ম-কানুন মেনে প্রয়াস চালানোর মাধ্যমে আয়ত্ত করা যায়। প্রতিদিন অব্যাহত চর্চার বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন ইবনে বাওয়াব। এর সাথে ক্যালিগ্রাফির সূক্ষ্ম সৌন্দর্যকে আয়ত্ত করার জন্য গোপন কৌশল ওস্তাদের কাছ থেকে জেনে নিয়ে যিনি এর প্রতি গভীর ভালবাসা ও মমত্ব হৃদয়ে ধারণ করে অনুশীলন করবেন তিনি লক্ষ্যে পৌছতে পারবেন। চর্চাকারীকে এর পেছনে নিরন্তর সময় ব্যয় করতে হবে। যখন কেউ ক্যালিগ্রাফির মূলনীতিগুলো আয়ত্ত করে ফলবেন, তখন তাকে মুক্ত হরফ কিংবা যুক্ত হরফ, জড়ানো শব্দ কিংবা টানা লেখা সবখানেই ভারসাম্য, সঠিক আকৃতি, পরিমাপ, ঐকতান ও অনুপাত বজায় রাখার দিকে সবিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। ইবনে বাওয়াব কখখ্যখালিগ্রাফির স্টাইল ও ফন্টের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেয়ার চেয়ে এর যথাযথ চরিত্র রক্ষার দিকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। তিনি কলম কাটার সঠিক পদ্ধতি সহজে কাউকে শেখাতেন না। কারণ এতে শৈলীগুলোর অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা করতেন তিনি। এ সম্পর্কে তিনি একটি কবিতার ছত্র বলতেন।আশা করোনা যে এর গোপনীয়তা আমি প্রকাশ করি। অবশ্যই এর গোপন কৌশল আমি সযতেœ লুকিয়ে রাখি। অগ্রনায়কেরা ক্যালিগ্রাফির হরফকে যথাযথ লেখর প্রতি যেমন গুরুত্ব দিয়ে ছত্রদের শেখাতেন, তেমনি কিভাবে ক্যালিগ্রাফির গোপন সৌন্দর্যগুলো লেখাতে ফুটিয়ে তুলতে হয় সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। এজন্য কয়েকটি মূলনীতি তারা দিয়েছেন। এক হরফকে যথাযথ আকৃতি ও পরিমাপে বারবার অনুশীলন করো যতক্ষণ না সেটা তোমার হৃদয়ে পুরোপুরি বসে যায়। দুই সঠিকভাবে কলম চালনা করো এবং হরফ পূর্ণভাবে লিখো। তিন. অকম্পিত হাতে প্রতিটি স্ট্রোক পূর্ণ করো। চার. প্রতিটি স্টাইলে, লাইনে গ্যাস ও শব্দের শুরু ও শেষ যথা নিয়মে করো। পাঁচ. প্রতি স্টাইলের কম্পোজিশন, লাইন ও বাক্যের শেষপ্রান্ত ও কোণাগুলো খেয়াল করো। একথাগুলো ফন্টের যতগুলো ধারা আছে সবার জন্য প্রযোজ্য। আবু হাউয়ান ইত তাওহীদী (মৃ. ১০১০ খৃ.) সর্বপ্রথম সঠিক ক্যালিগ্রাফি করতে সাতটি য়িম তার “রিসালাহ ফি ইলম আল কিতাবাহ” নামক রচনায় প্রকাশ করে। দুই. ঊর্ধ্বমুখীতাকে যথাযথ প্রয়োগ করো। তিন. গোলায়িত বাক্যগুলোতে অলংকার দাও। চার. লেখার শরুতে চমক দাও। পাঁচ. স্ট্রোকগুলোতে তিক্ষèতা প্রদান করো। ছয়. ফাঁকগুলোও যেন ছন্দময় হয়। সাত. পুরো ক্যালিগ্রাফিতে যথাযথ ধৈর্যসহকারে সম্পন্ন করো। এই নিয়মগুলো হচ্ছে ক্যালিগ্রাফির মূলনীতি এবং লেখার সবগুলো শাখার জন্য এটা প্রযোজ্য। লেখার কৌশলের বর্ণনা এবং লিপিশৈলীর বৈশিষ্ট্যগত বর্ণনা এক বিষয় নয়। এদের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। শৈলীগুলো সম্পর্কে আমরা ধারণা পাই ইবনে আস সাঈগ (মৃ. ১৪৪১ খৃ.) রচিত গ্রন্থে।” তুহফাত উলি আল আলবার ফি সিনাআত আল খাত ওয়া আল কিতাব”গ্রন্থে তিনি বলেন, রিয়াসী শৈলী হচ্ছে মুহাক্বাক-নাসখী শৈলীর কাছাকাছি একটি লিপি। কোন কোন বিশেষজ্ঞ একে তাওকী লিপির নিকটবর্তী একটি লিপি বলে উলে¬লখ করেন। কিন্তু তাওকী লিপিটি বেশি গোলয়িত স্বভাবের। সুতরাং রিয়াসী শৈলীটি মুহাক্বাক-নাসখী শৈলীর নিকটবর্তী বলে মতটি অধিক বিশুদ্ধ। আর যে সময় এই তুলনা করা হয়েছিল তখন তাওকী শৈলীটি সম্পর্কে অনেকেই অবগত ছিলেন না। বরং মুহাক্বাক ও নাসখী লিপিটি অধিক পরিচিতি ছিল। আস সাঈগ তার গ্রন্থের অন্যত্র বলেছেন, তাওকী শৈলীটি অবশ্যই সুলুস লিপি থেকে ছোট হবে। আর সুলুস লিপিটির আলিফ হবে কলমের ছয়টি ফোটা বা নোকতা বরাবর লম্বা। কলমের মোটা-চিকন নীবের প্রশস্ততার জন্য লিপির হরফগুলোর আকৃতি ছোট-বড় হবে। কিন্তু নিয়ম একই থাকবে। মুহাম্মদ ইবনে আল হাসান আত তীবী তার ক্যালিগ্রাফিবিষয়ক গ্রন্থে লিখেছেন, মোটা ও পুষ্টু সুলুস যাকে ‘জালি সুলুস’ বলা হয়। এই সুলুসের উললম্ব ও আনুভূমিক রেখা পুষ্টু ও মোটা হবে এবং এর ইলিফটি সাতটি নোকতা বা ফোটা বরাবর হবে আর খফি বা হালকা ধরনের সুলুস শৈলীতে আলিফটি হবে পাঁচ নোকতা বরাবর লম্বা। গোলয়িত ধারায় এর থেকে ছোট সব শৈলীকে ‘লুলু’ নামে অভিহিত করা হয়। এখানে লুলু শৈলীর কিছু বৈশিষ্ট্য দেয়া হলো,। ১. হরফগেলো আকৃতিতে অবশ্যই স্পষ্ট ও ক্ষুদ্রাকৃতির হতে হবে উলিলখিত লিপিদ্বয় থেকে। অর্থাৎ সুলুস জালি ও খকি থেকে। ২. জিম ও সদৃশ হরফগুলো ডানদিকে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ঝুঁকে থাকবে। ৩. ওয়াও এবং সদুশ হরফগুলো সুস্পষ্টভাবে গোলায়িত হবে। ৪. শুরুর ‘হা’ এবং সৃদশ হরফ প্রশস্ত হবে। ৫. তোয়া এবং সদৃশ হরফের ফাঁসটি ধনুকের মত টান টান বাকানো হবে। ৬. হরফের শেষপ্রান্ত বা স্ট্রোক তীক্ষè হবে। ৭. হরফগুলো প্রত্যেকটি একে অপর থেকে আলাদা হবে, কেউ কারো মধ্যে প্রবিষ্ট হবে না। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে হলে দেখুন নাজি জৈনউদ্দিন রচিত “মুসাওয়ার আল খাত আল আরাবী” নামক গ্রন্থের লুলু শৈলীর অধ্যায়। আত তীবী অবশ্য লুলুকে শেষ শৈলী হিসেবে দেখাননি। তীবী অবশ্য লুলুকে শেষ শৈলী হিসেবে দেখাননি। তিনি সুলুস, মুহাক্বাক ও মুয়ান্নাক শৈলীর মধ্যে পার্থক্য বৃঝাতে নুন, ওয়াও, রা এবং ইয়াকে পৃথক আকৃতির মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।তিনি স্পষ্ট করে বলেন, মুয়ান্নাক অবশ্যই সুলুস ও মুহাক্বাক শৈলীর সমন্বয়ে তৈরি নয়। তবে রাইহানী শৈলী মুহাক্বাক শৈলীর নানা বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছে। এক্ষেত্রে মুহাক্বাক থেকে রাইহান শৈলীর লাইন বা রেখা অধিক সূক্ষ্ম ও প্রশস্ত। সূক্ষ্ম বলতে অবশ্যই রিকা লিপিকে বুঝায়। সুতরাং সাধারণভাবে বর্ণনা দিয়ে স্টাইলগুলো পুরোপুরি বোঝানো সম্ভব নয়। যতটা না হাতে কলমে দেখানো যায়। এজন্যই ওস্তাদ ক্যালিগ্রাফারগণ থিউরীর চেয়ে ব্যবহারিক বা হাতে কলমে ক্যালিগ্রাফি শেখাকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। আততীবী বলেন, মুয়ান্নাক শৈলীতে ক্যালিগ্রাফি করতে যে কলম ব্যবহার করা হয়, একই মাপের কলম দিয়ে “আ‘সার” লিপির ক্যালিগ্রাফি করা যায়। আবার মুহাক্বাক ও নাসখী শৈলীতেও একই মাপের কলম ব্যবহার হয়ে থাকে। এছাড়া মুহাররাফ কলম দিয়ে মুহাক্বাক ও রাইহান লিপি লেখা যায়। মুদাওয়ার কলম দিয়ে রিকা ও তাওকী লিপি লেখা যায়। কিন্তু রিকা ও তাওকী লিপিদ্বয় মুহাক্বাক ও রাইহানী লিপিদ্বয়ের সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্র বৈশিষ্ট্যের। আততীবী তার রচনামালায় শৈলীর বর্ণনা অপেক্ষা কলম কাটা ও কোন কলমে কোন লিপি ভাল লেখা যায় তা বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তার পরেও তার রচনামালার বিভিন্ন স্থানে শৈলীর চরিত্র বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা আমরা দেখে থাকি। তিনি বলেন, রাইহান লিপি ও মুহাক্বাক লিপির অনুপাত হাওয়াশী ও নাসখী লিপির অনুপাতের সদৃশ। এ বর্ণনায় তিনি লিপির হরফের আকার বা সাইজের অনুপাতের কথা বলেছেন, কলমের নয়। এবার আমরা কুফি লিপির জন্য আল কালকাশান্দির (মৃ. ৮২১ হিজরী ১৪২৮ খৃ.) মতামত যাচাই করতে পারি। তিনি কুফি লিপির দুটো উৎসের কথা বলেন, তুমার কলম ও গুবার কলম। অর্থাৎ একটি বৃহদাকৃতির বা প্রশস্ত নীবের এবং অন্যটি ক্ষুদ্রাকৃতি বা ‘সূক্ষ্ম নীবের কলম দিয়ে লেখা হতো। তুমার কলমে লেখা কুফি লিপির চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, তুমার লিপির লাইনাগুলো (ভার্টিকেল ও হরাইজন্টাল) সব সময় সোজা ও তীক্ষè হবে। অন্যদিকে গুবার কলমে লেখা কুফি হবে কিছুটা গোলায়িত লেখার এবং এর ভার্টিকেল বা উললম্ব রেখাগুলো ডানে কিছুটা ঝুঁকে থাকে। এই গুবার কলমের এক তৃতীয়াংশ থেকেই মূলতঃ সুলুস লিপির জন্ম হয়। সুলুস শব্দের অর্থও “এক তৃতীয়াংশ”। এখন একথা হচ্ছে, এসব লিপিতে প্রতিনিয়ত উন্নয়ন ও সংস্কারের প্রয়াস চলেছে এবং সময়ের পরিক্রমায় তা নব নব নিয়ম-কানুন ও টেকনিক অবলম্বন করে এগিয়ে গেছে। এসব লিপি শৈলীর কোনটির উন্নয়ন হয়েছে বিশালভাবে, কোনটিতে তেমন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। আরবি ক্যালিগ্রাফির লিপিগুলোর নাম ও বর্ণনা আমরা চমৎকারভাবে ইবনে আন নাদিমের (মৃত্যু ৯৯৫ খৃ.) আফিহরিস্ত নামক গ্রন্থে দেখতে পাই, আল নাদিমের গ্রন্থে অবশ্য নামই পাওয়া যায় বেশি। যদিও নমুনা তিনি দিয়েছেন তবে ক্যালিগ্রাফির পান্ডুলিপিগুলো থেকে তিনি ততটা নমুনা না নিয়ে নিজেই কিছুটা পার্থক্য দেখিয়েছেন। কুফি লিপি সম্পর্কে জাওয়াদ আলী বলেন, ইরাকী, আনবার ও মাসক লিপির নামকরণে বেশ চাতুর্য রয়েছে, কারণ এগুলো ততটা যুথবদ্ধ নয় বরং এর লেখনরীতি বলা যায় অগোছালো। এটি মুলত: হালকা বৈশিষ্ট্যের বলেই এই নামকরণ করা হয়েছে, কারণ এলাকাভিত্তিক লিপির নামকরণের জন্যই সহজে এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ক্যালিড়্রাফারগণ বুঝতে পারতেন। হালকা ধরনের রেখার আরেকটি শৈলী হচ্ছে ‘জখম লিপি’। কুফি লিপির এই ধারায় বেশকিছু ভিন্ন ও পৃথক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ইরাকের হিরার অধিবাসীরা এই লিপিতে প্রচুর কুরআন অনুলিপি করেছেন। জাওয়াদ আলী এ বিষয়ে তার আল মুফাসসাল গ্রন্থে বিস্তারিত লিখেছেন। জৈনদ্দিন নাজি তার বিদাইয়াশ খত ওয়া খত্তাতীন গ্রন্থে ৮ম শতাব্দীর কয়েকজন তুর্কী ক্যালিগ্রাফারের কথা লিখেছেন। যারা বাগদাদের ইয়াকুত আল মুস্তাসীমীর নীতিমালা অনুসরণ করে ক্যালিগ্রাফি করতেন। এই তুর্কী ক্যালিগ্রাফারদের মধ্যে ৬ জনের নাম উলেলখ করা হলো: ১. আবদুললাহ আশ শায়রাফি। তিনি নাশখী লিপিতে খ্যাতি লাভ করেন। ২. আবদুললাহ আরগুন (মৃ. ৭৪২ হি.)। তিনি মুহাক্বাক লিপিতে বিখ্যাত ছিলেন। ৩. ইয়াহ ইয়া আস সুফী (মৃ. ৭৩৯ হি.)। তিনি সুলুস লিপিতে খ্যাতি অর্জন করেন। ইয়াকুত আল মুস্তাসীমীর সরাসরি ছাত্র ছলেন তিনি। ৪. মুবারক শাহ কুতুব (মৃ. ৭৩৫ হি.)। তিনি তাওকী লিপিতে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ৫. মুবারক শাহ আস সুয়ুফী (মৃ. ৭২০ হি.)। রাইহানী লিপিতে খ্যাতি লাভ করেন। ৬. আহমদ আস সুহরাওয়ার্দী তাইয়িব শাহ (মৃ. ৭২০ হি.)। রিকা লিপিতে খ্যাতি অর্জন করেন। এখানে আরেকটি কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি, একটি লিপি এা অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে গিয়ে ভিন্ন নামে কিংবা নামের সামান্য রদবদল যেমন হয়েছে, তেমনি লিপিটিতে সংস্কার ও উন্নয়ন হয়েছে। নাসখী লিপিটি বিশ্বব্যাপী কুরআনের লিপি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে, অঞ্চল ভেদে এর নামও পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। যেমন তুরস্কে একে ‘নেসিহ’ লিপি বলা হয়। ক্যালিগ্রাফারগণ প্রয়োজনবোধে তাদের লিপিটির যথাযথ বর্ণনা লিখে গেছেন, খলিফা আল মামুন নিজে নির্দেশ দিয়ে ‘নিশফ’ লিপিতে সরকারি কাগজপত্র লিখতে বলেন। পরে এর নাম হয় ‘রিয়াসী” বা সরকারি লিপি। আরবি ক্যালিগ্রাফির লিপিশৈলীর গভীরে যেতে হলে লিপিগুলো সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা থাকা প্রয়োজন। আমরা বাংলাভাষী বিধায় আরবি ক্যালিগ্রাফির সূক্ষ্ম শৈলীভিত্তিক পার্থক্য যেমন ধরতে পারি না, তেমনি এর অন্তরনিহিত মজাও পাওয়া যাচ্ছে না, পৃথিবীতে একমাত্র ট্রেডিশনাল আরবি ক্যালিগ্রাফির রয়েছে বিজ্ঞানসম্মত নীতিমালা ও কলাকৌশল। শিল্পের এই দ্রুপদি ধারায় যারা পদচারণা করবেন, যারা এর রস আস্বাদন করতে আগ্রহী, তাদের জন্য এর সম্যক ধারণা অর্জন ব্যতিরেকে সমালোচনা বাতুলতা মাত্র। তবে বাংলাদেশে পৃতিনিয়ত ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফিতে আগ্রহ বাড়ছে বলেই লিপির শৈলীভিত্তিক উৎকর্ষও হচ্ছে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন ক্যালিগ্রাফির প্রদর্শনীতে এর প্রমাণ আমরা প্রত্যক্ষ করছি, এর সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই আরো সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসবেন, এই আশা রাখা যায়। -মোহাম্মদ আবদুর রহীম

No comments:

Post a Comment