Wednesday, March 3, 2010

ক্যালিগ্রাফির নন্দনতত্ত্ব : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ


শিল্পকলার গুরুত্ত্বপূর্ণ একটি আভ্যন্তরীণ বিষয় হচ্ছে নন্দনতত্ত্ব। সহজ কথায় নন্দনতত্ত্ব হচ্ছে সৌন্দর্য বিষয়ক মত বা দর্শন। ক্যালিগ্রাফি যেহেতু শিল্পকলার প্রাচীন ও প্রধানতম অংশ। তাই ক্যালিগ্রাফির নন্দনতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে হলে কয়েকটি বিষয় খোলাসা হওয়া প্রযোজন। বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফির নন্দন বিষংক আলোচনায় এ অঞ্চলের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির বিশ্বাস, আচরণ, সৌন্দর্যপ্রিয়তা, মূল্যবোধ প্রভৃতি বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। ক্যালিগ্রাফির নন্দনতত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় আসলে আরবি ক্যালিগ্রাফির যে চর্চা সাম্প্রতিক বাংলাদেশে চলছে এর সাথে বাংলা ক্যালিগ্রাফি ও কিঞ্চিৎ অন্যান্য ভাষাবর্ণের ব্যবহার আমরা এখানে লক্ষ্য করে থাকি, তারই উলে¬লখের প্রয়াস থাকবে। ক্যালিগ্রাফি চর্চা এদেশে এখন বেশ জোরেশোরে চলছে। প্রতি বছর একক কিংবা দলগত প্রদর্শনী হচ্ছে, ক্যালিগ্রাফির সংগঠনও দু’চারটি হয়েছে তাদের কার্যক্রম চলছে, ক্যালিগ্রাফির শৈলী ও পেইন্টিং বিষয়ে এখন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। সেমিনার, ওয়ার্কশপ প্রভৃতির নিংমিত আয়োজন আমরা প্রত্যক্ষ করছি। এতে খুব দ্রুত আমাদের সামনে চলমান ক্যালিগ্রাফির আঙ্গিকগত, সরসরগত ও সৌন্দর্যবিষয়ক ধারণার পরিবর্তন হচ্ছে। বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি প্রধানত আরবি হরফনির্ভর। দর্শক ও ক্যালিগ্রাফির শিল্পকর্ম সংগ্রহকারীদের আগ্রহের দিক বিবেচনায় শিল্পী ও ক্যালিগ্রাফারগণও সেরকম শিল্পকর্ম তৈরী করে থাকেন বলে ধারণা হয়। আরবি হরফনির্ভর ক্যাফিগ্রাফিও এদেশের দু'টো ধারায় চর্চা হচ্ছে, শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফি এবং পেইন্টিং নির্ভর ক্যালিগ্রাফি। শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির নন্দতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এদেশের প্রচলিত আরবি হরফ সম্পর্কে সাধারণের মাঝে যে ধারণা রয়েছে সেটা বিবেচনা করা প্রয়োজন। এদেশের জনগোষ্ঠির বৃহত্তম অংশ আরবি হরফ বলতে কোলকাতা ছাপার কুরআনের হরফ বুঝে থাকেন। এই হরফ মূলত: নিশ্চল বা গতিহীন টাইপ সেট। এতে হাতের লেখার জীবন্তপ্রবাহ খুঁজে পাওয়া যায় না। যদিও খুব সীমিত পরিসরে লৌখনু ছাপার কুরআন রয়েছে, তবু তা অধিকাংশের কাছে পাঠ করা কঠিন বলে অনুযোগ রয়েছে। সুতরাং শৈলী বিষয়ক নন্দনতত্ত্বের আলোচনায় এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আরবি ক্যালিগ্রাফিতে শৈলীগত বিশুদ্ধতা যেটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, তার চর্চা আরব দেশগুলোতে বিদ্যমান রয়েছে। বিশেষ করে তুরস্কে আরবি হরফ তাদের ভাষায় এখন ব্যবহার না করলেও ক্যালিগ্রাফিতে এখন পর্যন্ত শৈলীগত বিশুদ্ধতায় তারা শ্রেষ্ঠ। সুলুস বা এক তৃতীয়াংশ, দিওয়ানী বা প্রশাসনিক, নাশখ বা কফি করা প্রভৃতি নামের শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফি চর্চায় তুরস্কের ক্যালিগ্রাফাররা প্রথম সারির ভূমিকা রেখে চলেছেন। সুতরাং তুরষ্কের শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির নন্দনরূপ আর বাংলাদেশের শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির সৌন্দর্যরূপ এক পর্যায়ের নয়। বাংলদেশের ক্যালিগ্রাফারগণ (হাতেগোণা কয়েকজন) শৈলীভিত্তিক যে ক্যালিগ্রাফি করে থাকেন, তা এ দেশের জনগোষ্ঠির দর্শনগত ও আরবি হরফের সাথে পরিচয়পূর্ব দিক বিবেচনায় সৌন্দর্যরূপ স্থানীয় মানের সাথে সামঞ্জস্যশীল। যদিও ইরানী নাস্তালিক শৈলীর ব্যবহার এখানে সাম্প্রতিক যা হচ্ছে। মাত্র ২শ বছর পূর্বেও তার থেকে বহু উঁচু মানের কাজ আমরা প্রাচীন শিলা লিপিতে দেখতে পাই। এমনকি সুলতানী আমলের বেঙ্গল তুগরা, সুলস, নাশখ প্রভৃতি শৈলীরও ব্যবহার এখন পূর্বের মান অতিক্রম করতে পারেনি। এখানে সাম্প্রতিক হাতে লেখা হয়েছে কয়েকটি কুরআনশরীফ যেমন-মেহেদি পাতার কুরআন, ইসালমিক ফাউন্ডেশনের লাইব্রেরিতে রক্ষিত কুরআন, এমন কি ১৯৭৭ সালে জাদুঘরের ইসলামিক প্রতœ প্রদর্শনীতে দেয়া এক মহিলা শিল্পীর হাতে লেখা কুরআন শরীফটির শৈলীগত মান আশাবঞ্জক নয়। এটা সম্ভবত এজন্য হয়েছে কারণ কোলকাতা ছাপার হরফ তাদের কাছে সৌন্দর্য রূপ হিসেবে প্রতিয়মান হয়েছে কিংবা তারা মৌলিক আরবি শৈলীর সাথে পরিচিত হতে পারেনি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের সহজ লভ্যতা, ইন্টারনেট, আরবি পত্র-পত্রিকা, এমনকি ডিশলাইনের আরবি চ্যানেলগুলোয় আরবি হরফের মনকাড়া অঙ্গসৌষ্ঠব দেখে আমাদের কাছে আরবি ক্যালিগ্রাফির স্বরূপ বিশেষ করে শৈলীগত বিশুদ্ধ সৌন্দর্যরূপ উন্মোচিত হতে চলেছে। সাম্প্রতিক পর্যায়ক্রমিক কয়েকটি ক্যালিগ্রাফির প্রদর্শনী পর্যালোচনা করলে শৈলীগত সৌন্দর্যরূপের এই পরিবর্তন চোখে পড়ে। এক দশক পূর্বে এদেশের ক্যালেন্ডারসমূহ ঘেটে দেখলে ক্যালিগ্রাফিবিহীন একটি দৃশ্য আমরা দেখতে পাই। কিন্তু এখন বহু প্রতিষ্ঠানের ক্যালেন্ডারে নিয়মিতভাবে ক্যালিগ্রাফি স্থান দখল করে চলছে। এসব ক্যালেন্ডারের ক্যালিগ্রাফিতে শৈলীবিষয়ক পরিবর্তন চোখে পড়ার মত। নন্দনতত্ত্বের এই যে স্বরূপ আমরা দেখছি সেটা দিন বদলের সাথেসাথে পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু ক্যালিগ্রাফির শৈলীভিত্তিক নন্দনতত্ত্ব বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে কী হওয়া উচিত সে আলোচনার চেয়ে পরিবর্তনের স্বরূপ আলোচনাটা বেশি ফলদায়ক। শৈলীর বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য উচ্চকিত এ দেশের শীর্ষ স্থানীয় একজন ক্যালিগ্রাফি শিল্পীর কাজে ‘ক্যালিগ্রাফি কলম’ অর্থাৎ খাগ বা বাঁশের কলমের সরাসরি প্রয়োগ এখনও আমরা দেখতে পাইনি। কিন্তু বাস্তব কথা হলো শৈলীর নন্দনতাত্ত্বিক পরিবর্তন বিশেষ করে ইমপ্র“ভমেন্ট বা উচ্চমানে আরেহণের জন্য ক্যালিগ্রাফি কলমের ব্যবহার অপরিহার্য। একথা এজন্য বলা হলো, যদি আমরা শৈলীর বিশুদ্ধতা কিংবা ইমপ্র“ভমেন্ট আক্ষরিক অর্থে সেভাবেই চাইতাম তাহলে নন্দনতাত্ত্বিক স্বরূপও আমরা সেরকম দেখতে পেতাম। আরবি ক্যালিগ্রাফির শৈলীভিত্তিক নন্দনতাত্ত্বিক বিষয়ে একটি কথা না বললেই নয়। প্রতি তিন বছর পর পর তরস্কে ওআইসির গবেষণা বিভাগ আন্তর্জাতিক শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। ২০০৬-০৭ সালে ৭ম হাশিম মুহাম্মদ বাগদাদী স্মরণে ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এতে লাখ লাখ টাকার পুরস্কার দেয়া হয় শুধু কাগজের ওপর কালো কালিতে ক্যালিগ্রাফির জন্য। প্রতিযোগিতার আয়োজকদের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির বিশুদ্ধতা রক্ষা ও এর নন্দন তাত্ত্বিক স্বরূপকে পশ্চিমা ক্যালিগ্রাফি কিংবা বিদেশী প্রভাব থেকে রক্ষা করে ইমপ্র“ভমেন্ট বজায় রাখা । অবস্য এর সাথে আধ্যাত্মিক স্পিরিটও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তাহলে আরবি ক্যালিগ্রাফির শৈলী ভিত্তিক নন্দন তাত্ত্বিক স্বরূপ বা দর্শন কি? কয়েকটি বিষয় এর সাথে জড়িত, হরফের সঠিক সেপ ও সাইজ যেটা আল খাত আল মানসুব বা আনুপাতিক লেখনীর সাথে সম্পৃক্ত এবং ইবনে বাওয়াবের মানসুব আল ফায়েক অর্থাৎ সৌন্দর্যময় লেখনী আক্ষরিক অর্থে আরবি ক্যালিগ্রাফির শৈলীভিত্তিক নন্দনতত্ত্বের সাথে সংশি¬লষ্ট। এছাড়া ইয়াকুত আল মুস্তাসিমীর কলম কাটার কলাকৌশল এতে পূর্ণতা এনেছে। কালির প্রস্তুতবিধি, ব্যবহার নীতিমালা, কাগজ বা উপায়-উপকরণ এটি নির্দিষ্ট বিধিমালার অন্তর্ভুক্ত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সুলুস লিপির আলিফটি ক্যালিগ্রাফি কলম দিয়ে লিখতে তিনটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। র’স বা মাথা হবে দেড় থেকে দুই ফোটা বা নোকতা বরাবর এবং হেসম বা শরীরটি ৫-৬ নোকতা বরাবর লম্বা হবে। শেষে মাথার নীচে আকশিটি কলমের ডান কোণা দিয়ে পূরণ করতে হয়। এটা হল সাধারণ নিয়ম কিন্তু হরফের আকৃতি ও পরিমাপ ঠিক রাখর সাথে সাথে এর রৈখিক বাক ও ভাজগুলোও যথাযথ করতে হয়। এটি সরাসরি নন্দনতত্ত্বের সাথে সংশি¬লষ্ট যেটা হাতেকলমে ওস্তাদ ছাত্রকে শিখিয়ে থাকেন, দর্শককেও এ বিষয়ে হাতে কলমে আত্মস্থ করতে হয়। বাংলদেশে ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে ইদানীং বেশ লেখা লেখি হচ্ছে, অনেকে আগ্রহ নিয়ে লিখছেন, কিন্তু ক্যালিগ্রাফির সত্যিকার উন্নয়নে যথার্থ আলোচনা আসছে না। বিষয়টির প্রতি ভালেবাসা ও আত্মিক অনুভব নিয়ে হয়ত তারা লিখছেন, যেমন- একটি জাতীয় দৈনিকে ক্যালিগ্রাফির নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে একজন এমফিল গবেষকের একটি লেখা ছাপা হয়েছে। আমার জানামতে, ১৯৭৯ সালে ড. পারেস ইসলাম ক্যালিগ্রাফির ওপর পিএইচডি ডিগ্রি লাভের পর ২০০৬ সালে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুহাম্মদ নূরুর রহমান এ বিষয়ে এমফিল ডিগ্রি লাভ করেছেন। তার অভিসন্দর্ভটির বিষয় ছিল “আরবি ক্যালিগ্রাফির উদ্ভব ও বিকাশঃ পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ।” এছাড়া আল কুরআনের ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে অন্য একজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল করছেন। কিন্তু ক্যালিগ্রাফির নন্দনতত্ত্বের মত স্পর্শকাতর ও সূক্ষ্ম টেকনিক্যাল বিষয়ে রচিত ভিন্ন বিষয়ে এমফিল গবেষকের লেখাটি যথার্থ আলোচনার দাবি পূরণ করেনি। লেখাটি মূলত ইতিহাস ও ক্রমধারার ওপর একটি গতানুগতিক রচনা। বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি সম্পর্কেও দায়সারা আলেচনা হয়েছে সেখানে এবং কিছুটা ফরমায়েসি ধরনের লেখা বলেও ধারণা হয়। তার লেখা ইতোপূর্বে দু’একবার ছাপা হয়েছে এবং সেগুলো একই রকমের। রচনাটি হযরত আলী (রাঃ) এর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু হয়েছে কিন্তু উদ্ধৃতিটি মূলতঃ রাসূলে আকরাম সাল¬লাললাহু আলাইহে ওয়াসাললামের। মুসনাদে ফেরদৌস, দায়লামী শরীফে হাদীসটির উল্লেখ রয়েছে (সূত্র ঃ কামেল সালমান আল জাবুরী, মুসেআহ আল খত আল আরাবি, পৃষ্ঠা-২০)। যাহোক আরবি ক্যালিগ্রাফি যাকে আল খত আল আরাবি বলা হয়। বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের দেশে যে উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে তাতে এ বিষয়ে যথার্থ আলোচনা ও চর্চায় সংশি¬লষ্টরা আরো আন্তরিক ও সক্রিয় হবেন এই আশা করা যায়।-মোহাম্মদ আব্দুর রহীম

No comments:

Post a Comment