Monday, March 8, 2010

ভারতে সাম্প্রতিক ক্যালিগ্রাফি চর্চা




ভারতের দিললীর একজন বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন উর্দু ক্যালিগ্রাফার হচ্ছেন আবদুল বাসিত হাশমী। ৫৫ বছর ধরে তিনি এই শিল্পময় হস্তলিপি চর্চা করছেন। ৭২ বছর বয়সী এই লিপিশিল্পী তার জীবনের প্রায় পুরোটা সময় লিপিচর্চার কাজে কাটিয়ে দিয়েছেন, দিললী জামে মসজিদের চত্বরের এক কোনে তাকে বসে থাকতে দেখা যায় আগ্রহী ক্রেতাদের জন্য। হয়ত কদাচিৎ কেউ আগ্রজ করে তার কাছ থেকে বিয়ের কার্ড, পোস্টার কিংবা কোন প্রচারপত্র বা মানপত্র লিখিয়ে নেয়। সন্ধ্যা হলে তিনি সরঞ্জাম গোছাতে গোছাতে স্বাগত কন্ঠে বলে ওঠেন, আগামী দিনটি যেন শূন্যতায় না কাটে। এটা তার নিঃসঙ্গতার চিত্র শুধু একার নয়। উর্দু ক্যালিগ্রাফি যাকে কিতাবাত বা খতাতী বলে দিললীবাসী ভালো জানে। যখন দশক দুই আগে দিললীতে কম্পিউটার এলো, তখন থেকে কিতাবাত পেশায় নিয়োজিতদের রুটি রুজিতে মারাত্মক প্রভাব দেখা দিল। মানুষ তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় লেখা লেখির কাজগুলো কম্পিউটার থেকে লিখে নিতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে লাগলো। কম্পিউটারে উর্দু ফন্টের ক্যালিগ্রাফিক চারিত্র পেশাদার কাতিবদের রোজগারে দারুন সংকট সৃষ্টি করেছে। সুতরাং নতুন প্রজন্ম হাতের লেখার প্রতি আগ্রহ হারিয়েছে বলে হাশমী মন্তব্য করেন। আমরা জানি ক্যালিগ্রাফি শব্দটি গ্রীক ক্যালোস অর্থাৎ সুন্দর এবং গ্রাফোস অর্থাৎ লেখা এর সমন্বয় হস্তলিপিকলা। প্রাত্যহিক কাজে ব্যবহৃত লিপি এবং হস্তলিপিকে ফাইন আর্ট বা ধ্রƒপদি কলায় প্রকাশ করার মাধ্যমে এটি জনগণের হৃদয়ে স্থানলাভ করেছে। ভারতে ক্যালিগ্রাফির কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন ধারা ও স্টাইল রয়েছে। পূর্ব এশিয়ান, তিব্বতী, ইসলামিক ও পশ্চিমা ধারা। ঐতিহাসিকরা বলছেন, হরপ্পা, মহেনজোদারো আর অশোকান আমলের স্থাপত্যে যে লিপিচিত্র উৎকীর্ণ রয়েছে তাই ভারতের প্রাচীন ক্যালিগ্রাফির নমুনা। আর দিললীতে ইসলামিক ক্যালিগ্রাফির পত্তন ও প্রসার ঘটান মোঘল শাসকরা। সাম্প্রতিক ভারতের ক্যালিগ্রাফি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন এ সময়ের খ্যাতিমান ক্যালিগ্রাফার আনিস সিদ্দিকী। তিনি ভারতের প্রাচীন এই শিল্পটি সম্পর্কে বলেন, ক্যালিগ্রাফির মত পবিত্র ও হৃদয়গ্রাহী শিল্পটি এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে দিনাতিপাত করছে। কারণ এর পেছনে কোন পৃষ্ঠপোষক নেই। তিনি নিজেও খুব খারাপ সময় অতিক্রম করেছেন বলে মন্তব্য করেন। তবে ক্যালিগ্রাফির উজ্জ্বল সময়ের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ১৮৫৭ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার মির পাঞ্জা কাশ, হিরালাল জয়পুরী, মুহাম্মদ ইউসুফ দিললীভি, যিনি দেশভাগের সময় পাকিস্তান চলে গিয়েছেন, মুন্সী ইয়াকুব সাহারানপুরী হাল আমলের উললে যোগ্য ক্যালিগ্রাফার। সিদ্দিকী বলেন, এখনও রাষ্ট্রপতি ভবনে গেলে মুহাম্মদ ইউসুফ দিললীভির শিল্পকর্ম দেখা যাবে। মুগল আমলের অবসান ও ইংরেজদের ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে ভারতে উর্দু ক্যালিগ্রাফির দূর্গতি শুরু হয়। দিললীতে এর প্রভাব পড়ে সবচেয়ে বেশী। ইংরেজরা সরাসরি ইংরেজী ক্যালিগ্রাফির জন্য সরকারীভাবে অর্থ সহায়তা দিতে থাকে এবং উর্দু-আরবী ক্যালিগ্রাফির জন্য নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বৃটিশ সরকার ইউরোপ থেকে বহু ইংরেজ ক্যালিগ্রাফা কে নিয়ে আসে এবং তাদের সরকারীভাবে নিয়োগ দেয়া হয়। ফলে উর্দু ক্যালিগ্রাফি মৃত্যু মুখে পতিত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে উর্দু ক্যালিগ্রাফির পুনর্জাগরণে বেসরকারীভাবে প্রয়াস লক্ষণীয়। সারা ভারতে ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর প্রোমশন অফ উর্দু ল্যাঙ্গুয়েজ (এনসিপিইউএল) ১৪টি কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে ক্যালিগ্রাফি প্রশিক্ষণের কাজ শুরু করেছে। এর একটি কেন্দ্র পূর্ব দিললীর সাদারায় বেশ সাড়া জাগিয়েছে। এছাড়া উর্দু একাডেমী ২ বছরের ক্যালিগ্রাফি কোর্স চালু করেছে। এই কোর্সের ৩০ জন ছাত্র একই সাথে ক্যালিগ্রাফি ও ডিজাইন সফটওয়ার শিখছে। সিদ্দিকীও সারিতা বিহারে একটি ক্যালিগ্রাফি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করেছেন। তিনি বলেন, কেউ যেন কম্পিউটারকে দোষ দিতে না পারে। এজন্য কম্পিউটার ও ক্যালিগ্রাফি একত্রে শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা নিয়েছি। সিদ্দিকী ক্যালিগ্রাফির ওপর গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। কম্পিউটারের ব্যবহারের সীমাবদ্ধতার কথা উললেখ করে বলেন, কম্পিউটারে উর্দু ক্যালিগ্রাফির সাধারণ টেক্স ব্যবহার করা সহজ এবং সাধারণ লেখার জন্য এটা খুবই উপযোগী অন্যদিকে খতাতি, যেটা ক্যালিগ্রাফারদের ছাড়া শুধু কম্পিউটার দিয়ে সম্ভব নয়। একজন ক্যালিগ্রাফারই পারেন কম্পিউটার ব্যবহার করে যথাযথ ক্যালিগ্রাফি করতে। সেক্ষেতেও রিড বা খাগের কলম হচ্ছে মূল মাধ্যম। কারণ সাধারণ মানুষ খাগের কলম ব্যবহারে পারদর্শী নয়। সুতরাং তারা কখনও ক্যালিগ্রাফারদের সমতুল্য হতে পারেনা। সাধারণ মানুষ এমনকি চারুকলার বহু শিল্পী ও কিতাবাত ও খতাতী একই বিষয় মনে করেন। কিন্তু আসলে তা নয়। আপনি কোন খতাতী াশল্পকর্ম দেখলেন। ভাষাটা আপনার জানা না থাকলেও দৃষ্টি নন্দন বিষয়ের জন্য সেটাতে আপনি আকৃষ্ট হতে পারেন। যেমন ধরুন একটি কুরআনের বাণীর ক্যালিগ্রাফি বা খতাতী আপনি দেখলেন, আরবী ভাষা কিংবা শিল্পকর্মে উপস্থাপিত লিপিটির মর্মোদ্ধার আপনি তাৎক্ষণিকভাবে করতে পারলেন না। কিন্তু এর প্রয়োগরীতি উপস্থাপন কৌশল ও সূক্ষ্ম শিল্পবোধ আপনার হৃদয়কে আলোড়িত করবে আপনি এত মুগ্ধ হবেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কোন কোন অনুভবে। সিদ্দিকী অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেন যে, ক্যালিগ্রাফিতে প্রাচীনকাল থেকে সাম্প্রতিক সময়েও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রীড পেন বা খাগের কলম। সারা পৃথিবীতে মানুষ ক্যালিগ্রাফির শিক্ষা গ্রহণ করে খাগের কলমের মাধ্যমে। কারণ খাগের কলমের কোন বিকল্প আজও বের হয়নি। ভারতে খাগের কলমের প্রায় ৩৫ প্রকারের নাম পাওয়া যায়। যেমন দিললীতে এক সারকান্দা, পাঞ্জাবে একে কান্না এবং পশ্চিম বাংলায় একে কাতপথী নামে ডাকা হয়। ভারতে নব উত্থান পর্ব চলছে ক্যালিগ্রাফির। সিদ্দিকী মনে করেন, একে সংরক্ষণ ও চলমান রাখতে বিদ্যালয়ে পাঠ্য করা উচিত এবং এটি পেশা হিসেবে স্বীকৃতি ও সরকারীভাবে এর ক্ষেত্র তৈরী করে নিয়োগের ব্যবস্থা করা উচিত। দেখুন, মানুষ এতে আগ্রহী হয় না এজন্য যে এটা পেশা হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। সিদ্দিকী বলেন, দুই দশক ধরে তিনি ক্যালিগ্রাফি চর্চা ও সমাজে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কাজ করছেন, কিন্তু দশ বছর আগেও তিনি এর কোন উজ্জ্বল ভবিষ্যত দেখতে পাননি। এমনকি কোন সুযোগও তিনি পাননি। তিনি উললেখ করেন যে, সম্রাট শাহজাহান, আওরঙ্গজেব এবং বাহাদুর শাহ জাফর দিলেন ভারতের নামকরা ক্যালিগ্রাফার। সম্রাট আকবর ক্যালিগগ্রাফার হিসেবে পরিচিতি না পেলেও শিক্ষাক্ষেত্রে সিলেবাসে ক্যালিগ্রাফিকে বাধ্যতামূলক করেছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের ক্যালিগ্রাফাররা সরকারীভাবে এ শিল্পে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের জোর দাবী জানাচ্ছেন। -মোহাম্মদ আবদুর রহীম

No comments:

Post a Comment