বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনে নবপ্রতিষ্ঠিত ভিন্ন যে ধারাটি উজ্জ্বল উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে, সে ধারাটি হচ্ছে ক্যালিগ্রাফি। বাংলাদেশের একাডেমিক শিল্পধারায় যদিও ক্যালিগ্রাফির কথা রয়েছে। তবু কী কারণে যে এত বছর ধরে তা চরম অবহেলা পেয়ে এসেছে সেটা বোধগম্য নয়। চারুকলা পাস অধিকাংশ শিল্পীর ধর্মবিশ্বাস যদিও ইসলাম, কিন্তু তাদের ভেতর ক্যালিগ্রাফির প্রতি তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি। হয়ত ইসলামে প্রাণীচিত্র অঙ্কন নিষিদ্ধ জেনে পুরো শিল্পচর্চাকে তারা ইসলাম বহির্ভূত মনে করেন। অথচ এশিয়ান বিয়েনালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা বিপুল সংখ্যক শিল্পকর্ম কিন্তু ক্যালিগ্রাফি নির্ভর এবং সেটা আরবী ক্যালিগ্রাফি নির্ভর। ১৯৮৬ এর ৩য় বিয়েনাল ও ১২শ বিয়েনাল অর্থাৎ ২০০৬ সালের এই এশীয় দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনীতে গ্রান্ড প্রাইজ পেয়েছে ক্যালিগ্রাফি নির্ভর শিল্পকর্ম। এছাড়া প্রায় প্রতিটি বিয়েনালে বহুসংখ্যক ক্যালিগ্রাফি নির্ভর শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হওয়ার পাশাপাশি অনারেবল মেনশন পুরস্কারও পেয়েছে। ক্যালিগ্রাফি যেহেতু হরফ নির্ভর কলা, সুতরাং পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার হরফে ক্যালিগ্রাফি হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বতন্ত্র শিল্প হিসেবে শুধুমাত্র আরবী ক্যালিগ্রাফি প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। এর প্রধান কারন কারণ আরবী লিপির ছন্দময় গতিপ্রকৃতি নিখুঁত শৈলী ও উপস্থাপন চাতুর্য। সম্প্রতি দুবাইয়ে পরপর দুটি শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী হয়েছে। লন্ডনে, সিউলেও ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীর সংবাদ আমরা পেয়েছি। বাংলাদেশেও ৯ম ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়ে গেল মে ২০০৬। বিশ্বব্যাপী ক্যালিগ্রাফির এই যে প্রচার, প্রসার ও খ্যাতি, সেটা মূলত এর শৈলী ভিত্তিক উপস্থাপনার জন্য।বর্তমাে বাংলাদেশে আরবী ক্যালিগ্রাফির একটি চলমান জোয়ার আমরা প্রত্যক্ষ করছি। এ বিষয়ে দর্শক, শিল্পী, সমালোচক, মিডিয়া, পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান, সংগঠন সবার মাঝে ব্যাপক কৌত’হল ও আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে গত এক দশকে ক্যালিগ্রাফি শিল্পকে পরিণত শিল্পযাত্রা হিসেবে উপস্থাপন করতে দেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পীদের আগ্রহ ও প্রয়াস উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পে শৈলীর বিপরীতে পেইন্টিং বিষয়টি প্রবলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। স্বভাবত এ শিল্পের সাথে জড়িত অধিকাংশ শিল্পী একাডেমিক শিল্পচর্চায় রত কিংবা সৌখিনভাবে প্রচলিত শিল্প সম্পর্কে অবগত, কিন্তু শৈলীগত দিক থেকে পেছনে থাকার মূল কারণ হচ্ছে বাংলাদেশে এ বিষয়ে একাডেমিক শিক্ষার কোন সুযোগ না থাকা। তারপরেও ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফিতে যারা প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন, সংখ্যায় তারা হাতে গোনা হলেও দিন দিন এ সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের টেট্রডিশনাল আরবী ক্যালিগ্রাফি কোন অবস্থানে রয়েছে সে সম্পর্কে যথাযথ মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন। কারণ দেশে ক্যালিগ্রাফির বহু সংখ্যক প্রদর্শনী হলেও এখনো আন্তর্জাতিক কোন প্রদর্শনী হয়নি। সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী আয়োজনের পূর্বে অন্তত শৈলীভিত্তিক কাজে সেই মান থাকাটা সম্মানের পশ্ন হয়ে দেখা দেয়। এ পর্যন্ত দেশে যত গুলো ক্যালিগ্রাফির একক ও দলগত প্রদর্শনী হয়েছে সে সব প্রদর্শনীতে অংশ গ্রহণকারী শিল্পীদের শৈলীভিত্তিক কাজ বিবেচনা করলে বিশেষ করে যারা শৈলীকে গুরুত্ব দিচ্ছেন এমন কয়েকজন শিল্পী হচ্ছেন, শহীদুল্লাহ এফ. বারী, আরিফুর রহমান, বশীর মেসবাহ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া নবীনদের মধ্যে আবু দরদা নুরুল্লাহ, নিসার জামিল ও মোস্তফা আল মারুফের কাজে শৈীৈর বিষয়টি চোখে পড়ার মত। অন্যান্য আরো কয়েকজন রয়েছেন যারা প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন, শৈলী বা ট্রেডিশনাল ধারার বিষয়টি একটু খোলাশা হওয়া প্রয়োজন। আরবী ক্যালিগ্রাফির প্রধান কয়েকটি লিপি হচ্ছে, কুফি, সুলস, নাশখ, দিওয়ানী, ফারেসী প্রভৃতি ও ফারসী ধারার দুটি প্রধান লিপি নাস্তালিক ও শিকাস্তে। এসব লিপির সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা আমাদের সামনে রয়েছে, এখন এসব লিপিতে নতুন করে ক্যালিগ্রাফির শিল্পকর্ম করার যে প্রয়াস ও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে সেটা মূলতঃএর উপস্থাপন কৌশল, সেটা মূলতঃ এর উপস্থাপন কৌমল, কম্পোজিশন ও ভাঙ্গাগড়ার কাজের সাথে নিরীক্ষার প্রয়োগ। সুতরাং নির্দ্টভাবে যদি বলতে হয়, যে কোন শৈলী যেমন ধরা যাক ‘সুলস শৈলী’ এটি বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় ও অলংকার সমৃদ্ধ লিপিধারা। একে সুলতানুল খুতুত বা লিপিসমূহের বাদশাহ ও উম্মুল খুতুত বা লিপিসমূহের বাদশাহ ও উম্মুল খুতুত বা লিপিসমূহের জননী বলা হয়। এর তাশকিল বা অলংকার অথ্যন্ত দৃষ্টি নন্দন ও ছন্দময়। এই লিপিতে বাংলাদেশের শিল্পীদেও সর্বধিক সংখ্যক ক্যালিগ্রাফি রচিত হয়েছে। সুতরাং শিল্পীদের কাজের মূল্যায়ন করতে গেলে এ লিপিটির আক্ষরিক আলোচনা এসে যায়। সত্য কথা বলতে গেলে, ক্যালিগ্রাফি মূলতঃ ওস্তাদ নির্ভর শিল্প, শুধু দেখে দেখে কিংবা বই দেখে শৈলী ভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির শত ভাগ কি অর্ধাংশও আয়ত্ব করা দুস্কর। বাস্তব কথা হচ্ছে একজন ওস্তাদেও কাছে ৗশলীর তালিম নিলে ওয হরফ ছয় যে হরফ ছয় মাসে আয়ত্ব করা যায়, সেটা ওস্তাদ ছাড়া ষোল বছরেও ষাট ভাগ আয়ত্ব হয় না। এর সাথে সংশ্লিষ্ট লিপিশিল্পীরা এবিষয়ে বাস্তব প্রমাণ। প্রতিটি শৈলীর কিছু গোপন টেকনিক ও রহস্য রয়েছে। কলম কাটা, দোয়াতের ব্যবহার, কলম ধরা, কাগজের মাপের সাথে কলমের নীবের মাপ, শৈলীর হরফ, লেখার স্ট্রোক ও তারতীবÑতাহকীব সবই রহস্যময়। এই রহস্য ওস্তাদ ছাত্রদের সামনে হাতে কলম উন্মেচন করেন। ক্যালিগ্রাফির অগ্রদূত ও জনক বলে স্বীকৃত ক্যালিগ্রাফার ইবনেবাওয়াব (মৃ. ১০২২) বলেন যে, তিনি কলম কাটতে আড়ালে চলে যেতেন, যাতে এর রহস্য অন্যদেও কাছে প্রকাশ না পায়। কিখ্যাত ফার্সী ক্যালিগ্রাফার মীর আলী, হেরাত (মৃ. ১৫৫৬) -১ম কিস্তি
-মোহাম্মদ আবদুর রহীম
No comments:
Post a Comment