শিল্পকলার জগতে ক্যালিগ্রাফি একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ইসলামে আরবি ক্যালিগ্রাফিও পৌছে গেছে দেশে দেশে। এই শিল্পটি যেমন সত্য সুন্দরের বাহন, তেমনি আত্মার খোরাক। আব্বাসীয় আমল (৭৫১-১২৫৮) থেকে আরবি ক্যলিগ্রাফি শৈল্পিক র বাণী পৌছানোর সাথে সাথেআধ্যাত্মিক বিকাশ ঘটতে শুরু করে। প্রয়োজনীয় উপকরণ ও যন্ত্রপাতির মাধ্যমে আধ্যাতিক রেখা অঙ্ককে আরবি ক্যালিগ্রাফি বলে। ইংরেজীতে একে বলে ¯িপরিচুয়াল জিওমেট্রি। তুর্কী ভাষায় যাকে রুহী হান্দেজ বলা হয়ে থাকে। নন্দন তাত্ত্বিক এই সংজ্ঞা কালের বিচারে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত। হরফের পর হরফ বসিয়ে এবং হরফের নানান রূপের ব্যবহারে একটি ক্যালিগ্রাফি সার্থকভাবে আধ্যাত্মিক ভাব প্রকাশ করে।আরবি হরফের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে কোন হরফ শব্দের প্রথমে মধ্যে ও শেষে ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়। শৈল্পিক বিচারে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই শব্দ বিভিন্নভাবে লেখা যায়। আকৃতিগত ভিন্নতার জন্য একই শব্দে সৃজনশীলতার যোগ ঘটিয়ে কম্পোজিশনে বিভিন্নতা আনায়ন করা হয়। যা হয়ে ওঠে শৈল্পিক সৌন্দর্যমন্ডিত। ইসলামী ক্যালিগ্রাফি হিসেবে এখন আরবি ক্যালিগ্রাফিকেই বুঝানো হয়। আরবি ক্যালিগ্রাফি প্রয়োগ সুবিধা, নান্দনিক মান বা এসথেটিক ভেলু এবং আলল¬হর বাণী কুরআনের বাহন হওয়ায় এটা বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। আমরা জানি গবেষকগণ বলেন, নাবাতীয় হরফ থেকে আরবী হরফের উৎপত্তি কিংবা আম্বর, হিরা অঞ্চলের বিশেষ প্রভাব অথবা ফিনিশিয় হরফর গোত্রভুক্ত আরবী হরফ পবিত্র কুরআনের লিপি হওয়ায় এটি বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। ধীরে ধীরে মাক্বী-মাদানী, লিপি হিসেবে কুফী লিপির গোলায়িত ও ঋজু ধারায কুরআনের অসংখ্য অনুলিপি তৈরি হয়। এভাবে বড় মাপের নীবের থেকে বিভিন্ন মাপের কলম তৈরি হয়। ফলে নিসফ বা অর্ধেক, সুলুস বা একর্ তীয়াংশ যাকে কালিমুন নিসফ অর্থাৎ অর্ধেক কলম, হাফিফুন নিসফ বা এক তৃতীয়াংশ, হাফিফুন সুলুস বা দুই তৃতীয়াংশ মাপের কলম দিয়ে লেখা হয়। স্টাইলের নামকরলও হয় তদানুযায়ী। নির্দিষ্ট মাপের কলম দিয়ে নির্দিষ্ট মাপের কাগেেজ লেখা বাধ্যতামূলক করা হয় বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য। উমাইয়া আমলেই (৬৬১-৭৫০) এই উন্নয়ন সাধিত হয়। এরপর আব্বাসীয় আমলে ক্যালিগ্রাফি আর্টিস্টিক ধারায় প্রবাহিত হতে শুরু করে। এ সময় শুরু হয় পবিত্র কুরআনের কপি অলংকরণ। এতে তুর্কি ক্যালিগ্রাফাররা রেখে যান একটি বড় ভূমিকা। এর ভেতর মুহাক্কাক লিপি যেটি ইরাকী নামেও পরিচিত ছিল ইবনে মুকলার আনুপাতিক লেখনীর মাধ্যমে এই উন্নয়ন স্বর্ণশিখরে আরোহন করে। ইসলামী ক্যালিগ্রাফির সাথে আরো যেসব বিষয় সংশি¬লস্ট, তা হচ্ছে যুখরুফাহ আল আরাবিয়া বা অলংকরণ, স্বর্ণমন্ডিত বা গি¬ল্ডিং, কাগজের বর্ডার ডিজাইন, কাগজ মারবেলিং, মিনিয়েচার পেইন্টিয়ের এ্যবস্ট্রাক্ট অংশ। আরবি ক্যালিগ্রাফির আধ্যাতিক দিক বিবেচনায় এ শিল্পের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত শিল্পীদের কর্মকান্ড বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। আব্বাসীয় আমলের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার ইয়াকুত আল মুস্তসিমী নানান কর্মকান্ড ও শিল্পকর্ম তৈরীর পাশাপাশি পবিত্র কুরআনের এক হাজার অনুলিপি তৈরী করেছেন। বিষয় প্রকৃতপক্ষেই অত্যন্ত আশ্চর্য্যরে। কারণ শতখানেক কুরআনের অনুলিপি করেছেন এমন ক্যালিগ্রাফার যেখানে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সেখানে এক হাজার কপি লেখা আসলে অলৌকিক ব্যাপার। ক্যালিগ্রাফির আধ্যাত্মিকতা সমাজের নিম্ন উচ্চ সবারই ওপর প্রবল প্রভাব ফেলেছে। সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদ আমলের একটি ঘটনা। সে সময়ের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার শেখ হামদুল¬লাহকে সুলতান অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন। এতে সমসাময়িক জ্ঞানীগুণী, গবেষকগণ হামদুল¬লাহকেও ঈর্ষা করতে শুরু করেন। একথ জানতে পেরে সুলতান সে সময়ের সকল গবেষক, স্কলার, বুদ্ধিজীবীকে তার প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানান। শেখ হামদুললাহকেও আসতে অনুরোধ করেন। সবাই প্রাসাদে উপস্থিত হলে ড্রত্যেকের কাছ থেকে তাদের লিখিত গ্রন্থ নিয়ে দরবারের মধ্যখানে স্তুপ করেন। এরপর হামদুললাহর হাত থেকে তার হস্তলিখিত কুরআন কপিটি নিয়ে উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এই কুরআন কপিটি কি এই স্তুপের শীর্ষে স্থাপন করবো নাকি ভিতরে ঢুকিয়ে দেবো। তখন সবাই কুরআনের কপিটি গ্রন্থরাজির স্তুপের শীর্ষে স্থাপনের পক্ষে মত প্রদান করেন। তখন সুলতান ঐ গ্রন্থরাজির লেখকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, এই গ্রন্থ যেমন সম্মানিত ও মর্যাদাবান, এর লিপিকারও তেমনি সম্মানিত ও উচ্চাসনের অধিকারী, সুতরাং আমি আশা করবো আপনাদের কারো কাছ থেকে যেন এর লিপিকারের প্রতি সামান্যতম অসম্মানের কোন কিছু প্রকাশ না পায়। ক্যালিগ্রাফির আধ্যাত্মিকতা দর্শকদেও যেমন প্রভাবিত করে তেমনি স্বয়ং ক্যালিগ্রাফি শিল্পীই এর আধ্যাত্মিকতা মর্মে মর্মে অনুভব করে থাকেন। ক্যালিগ্রাফি শিল্প কর্ম করতে প্রত্যেক শিল্পী নিজেকে পবিত্র রাখেন এবং স্রষ্টার একান্ত সাহায্য ও আনুকুল্য কামনা করেন। এতে করে শিল্পকর্মের ভেতর উপস্থাপিত হরফের রেখাগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে এবং স্রষ্টার সাথে মৌন আলাপনের ভাব হৃদয়ে জেগে ওঠে। বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্প সেই আধ্যাত্মিক পথেই ধাবিত হচ্ছে। ট্রেডিশনাল ধারা কিংবা পেইন্টিংয়ে উপস্থাপিত ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম আমাদের আন্দোলিত করে আর নির্মল রসে সিক্ত করে। গত একদশক ধরে বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্প বিশেষ করে ঢাকা সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র ক্যালিগ্রাফি সোসাইটির যৌথ আয়োজনে প্রতি বছর সীরাতুন্নবী (সঃ) উপলক্ষে রবিউল আউয়াল মাসে অনুষ্ঠিত ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী একটি বিশাল আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছে। এই প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্মের আধ্যাত্মিক প্রভাব আমরা সমাজের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে লক্ষ্য করছি। প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ক্যালেন্ডারে ব্যাপকভাবে ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার হচ্ছে। সত্য ও সুন্দরের চর্চায় ক্যালিগ্রাফির আধ্যাত্মিক প্রভাব তাই অনস্বীকার্য। বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি একটি মহৎ শিল্পধারা হিসেবে সফলভাবে এগিয়ে চলতে সংশি¬লষ্ট সকলের আরো সক্রিয় ও আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করছি।-মোহাম্মদ আবদুর রহীম
Wednesday, March 3, 2010
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment