১৯৯২ সালে ৩য় আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতার মর্যাদাসম্পন্ন আসরে আমেরিকার মুসলিম ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন। শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমেরিকায় মুসলিম ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরা স্বাতন্ত্র পরিচয় সংরক্ষণে এই প্রতিযোগিতায় নিজেদের শিল্পকর্ম তুলে ধরেন। শুধু আমেরিকাই নয় বিশ্বব্যাপী মুসলিম সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক শৈল্পিক মাধ্যম হচ্ছে ক্যালিগ্রাফি। বিশেষ করে উত্তর আমেরিকার মুসলিম ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরা অনুভব করছেন, মুসলিম সমাজ প্রাত্যহিক জীবন যাত্রায় নানাদিক থেকে পশ্চিমা ও ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রভাবের মুখে নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় সংরক্ষণ করাটা একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে শিল্প ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে এই চ্যালেঞ্জ প্রকট হঢে দেখা দিয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ইসলামের আবির্ভাবের শুরু থেকেই ক্যালিগ্রাফিকে শিল্প বা আর্ট অঙ্গনে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফিপ্রদর্শনীর আয়োজন করে তাকে ইস্তাম্বুলভিত্তিক ইসলামিক হিস্ট্রি, আর্ট ও কালচারের গবেষণা কেন্দ্র। প্রতি তিন বছর পরপর আয়োজিত এই প্রতিযোগিতার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইসলামিক আর্ট হিসেবে ক্যালিগ্রাফির ক্ল্যাসিক ফর্মের উন্নয়নসাধন করা। এর কারণ হচ্ছে, ট্রেডিশনাল স্পিরিটকে বিদেশী প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে মৌলিক নীতিমালা ও বিশুদ্ধ শৈলীর গুণাগুণকে সংরক্ষণ করা। প্রথম আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতা ১৯৮৬ সালে বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার হামিদ আইতাক (হামিদ আল আমিদি) (১৮৯১-১৯৮২) স্মরণে ইস্তাম্বুলে আয়োজন করে রিসার্চ সেন্টার ফর ইসলামিক হিস্ট্রি, আর্ট এন্ড কালচার (আই আর সি আই সি এ)। ১৯৮৯ সালে দ্বিতীয় পতিযোগিতা প্রখ্যাত ক্যালিগ্রাফার ইয়াকুত আল মুস্তাসিমী (মৃত্যু-১৯২৮) স্মরণে, তৃতীয় প্রতিযোগিতা ১৯৯২ সালে ক্যালিগ্রাফির জনক ইবনে আল বাওয়াব (মৃত্যু-১০২২) স্মরণে, চতুর্থ ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতা। (১৯৯৭) শেখ হামদুললাহ (১৪২৯-১৫২০) স্মরণে, পঞ্চম ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতা (২০০০) সাইয়েদ ইবরাহীম (১৮৯৭-১৯৯৪) স্মরণে, ৬ষ্ঠ ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতা (২০০৩) মীর ইমাদ আল হাসেনী (১৫৫৪-১৬১৫) স্মরণে এবং ২০০৬ সালে এবারের ৭ম ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতাটি বিখ্যাতি ক্যালিগ্রাফার হাশিম মুহাম্মদ আল বাগদাদী (১৯১৭-১৯৭৩) স্মরণে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বহুদেশ থেকে ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরা অংশগ্রহণ করছেন। বরাবরের মতো আমেরিকার স্বনামধন্য ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরাও এতে অংশগ্রহণ করছেন। এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে শিল্পীরা অংশগ্রহণ করছেন। ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি বাংলাদেশের উদ্যোগে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত ৭ম আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ থেকে অংশগ্রহণ করছেন ক্যালিগ্রাফি শিল্পী শহীদুললাহ এফ. বারী, আরিফুর রহমান, বসির মেসবাহ, মোহাম্মদ আবদুর রহীম, আমিনুল ইসলাম, নেসার জামিল, আবু দারদা, মোঃ মোরশেদ, মাসুম বিললাহ, ফজলুল হক মারুফ রায়হান ও সিদ্দিকা আফরিন প্রমুখ। তৃতীয় আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতায় আমেরিকা থেকে ৪ জন ক্যালিগ্রাফি শিল্পী পুরস্কার অর্জন করেন। পুরস্কার প্রাপ্তরা হলেন, আবদুল লতীফ মাদাকী, মামুন সাককাল, আবদুল রহমান ইউসুফ ও মুহাম্মদ জাকারিকা। প্রতিযোগিতায় মোট পুরস্কার মূল্য ছিল ৪০ হাজার ২শ ডলার। ১৯টি পুরস্কারসহ ৫৭টি মেনশন ও ৪৮টি ইনসেনটিভ পুরস্কার ছিল। ২৬টি দেশের ৯৬ জন প্রতিযোগী এতে অংশগ্রহণ করেন। একটি সুদৃশ্য ক্যাটালগে এই শিল্পকর্মগুলো প্রকাশ করা হয়। আমেরিকার নিউইয়র্কে বসবাসরত ভারতীয় বংশোদ্ভুত আবদুল লতিফ মাদাকা ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট জালি সুলুস ও জালি দিওয়ানীতে মেনশন পুরস্কার লাভ করেন। মাদাকা ভারতের হায়দারাবাদে শৈশবে ক্যালিগ্রাফিতে দীক্ষালাভ করেন। ১৯৯৩ সালে মাদাকীর একক প্রদর্শনী নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হয়। মামুন সাক্কাল কুফী শৈলীতে প্রথম পুরস্কার অর্জন করেন। সূরা আল বাকারার ১৪৪ নং আয়াতকে তিনি পবিত্র কাবার আদলে উপস্থাপন করেন। তিনি সিরিয়ার আলেপ্পোয় ক্যালিগ্রাফার ইবরাহীম রিফাইয়ের কাছে ক্যালিগ্রাফি শিখেন। ১৯৭৮ সালে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ক্যালিগ্রাফির ওপর অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। গ্রাফিক ডিজাইন ও স্থাপত্য ডিজাইনে তিনি স্থানীয়ভাবে খ্যাতি লাভ করেছেন। এছাড়া মসজিদ ও ধর্মীয় ইমারাতসমূহে তিনি প্রচুর ক্যালিগ্রাফি প্যানেল তৈরি করেছেন। ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণকারী ক্যালিগ্রাফার আবদুল রহমানইউসুফ ১৯৯৩ সালে আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি টেক্সাসের ডালাস থেকে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৯১ সালে এবং ১৯৯৩ সালে দিওয়ানী শৈলীতে মেনশন পুরস্কার লাভ করেন তিনি। ১৯৮৭ সালের প্রথম আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতায় ক্যালিফোর্নিয়ায় জন্মগ্রহণকারী মোহাম্মদ জাকারিয়া জালি সুলুস শৈলীতে একটি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৩ সালে ৩য় প্রতিযোগিতায় তিনি একই শৈলীতে ইনসেনটিভ পুরস্কার লাভ করেন। টিন এজার বয়সে জাকারিয়া ইসলাম গ্রহণ করেন এবং একমাত্র মার্কিন মুসলিম নাগরিক হিসেবে ক্যালিগ্রাফিতে তুর্কী ডিপে¬লামা “ইযাজেত” গ্রহণ করেন। তিনি আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্যালিগ্রাফির ওপর শিক্ষা প্রদান করেন। ক্যালিগ্রাফির ওপর লেখা তার দুটি মূল্যবান গ্রন্থ রয়েছে। বই দু’টির নাম হচ্ছে, দ্যা আর্ট এবং অবজাভেশনস অন ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি। আমেরিকার বহু জাতিক সমাজে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও শিল্পাঙ্গনে ক্যালিগ্রাফি একটি উলেলখযোগ্য স্থান দখল করে রয়েছে, মামুন সাক্কাল ২০০৬ সালের এপ্রিলে আমেরিকায় আরবি ক্যালিগ্রাফি ও টাইপোগ্রাফি বিষয়ক একটি কনফারেন্সের আয়োজন করেন। এ কনফারেন্সে ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকার কয়েকটি দেশ থেকে প্রায় ৩০ জন বিশেষজ্ঞ বক্তব্য রাখেন। এতে একটি ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হয়। বিশ্বের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইসলামী শিল্পকলা সুস্থ, সুন্দর জীবনের পথ দেখায়, ইসলামী কক্যালিগ্রাফিকে অবলম্বন করে আমেরিকার কয়েকজন নিবেদিত প্রাণ মুসলিম শিল্পী নিরলস কাজ করে চলেছেন। সাম্প্রতিক ক্যালিগ্রাফি নিয়ে তাদের এই প্রয়াস ভবিষ্যতে আমেরিকায় ক্যালিগ্রাফিতে উজ্জ্বল পথ রচনা করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। -মোহাম্মদ আবদুর রহীম
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment