Wednesday, March 3, 2010

তুরস্কের সাম্প্রতিক ক্যালিগ্রাফি চর্চা




তুরস্কের শিল্পকলার ইতিহাসে ক্যালিগ্রাফি একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বিশ্বের শিল্পকলায়ও এর অবস্থান উলেলখ করার মত। আরবী লিপিকলার ইতিহাসে নান্দনিক, ঐতিহ্যিক ও নিজস্বধারা হিসেবে তুরস্কের ক্যালিগ্রাফি সব সময় শিল্পমানকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। বিশেষ করে তুরস্কের ইসলাম প্রবেশ করার মাধ্যমে আরবী লিপির উৎকর্ষ শুরু হয়। ইসলাম রাজশক্তি হিসেবে ১৫১৭ খৃঃ তুরস্কে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ক্যালিগ্রাফিতে দ্রুত উন্নয়ন সাধিত হয়। তুর্কী ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এর উন্নয়নে। আরবী ক্যালিগ্রাফির সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা দিয়েছেন ইসলামী গবেষকরা। সেটা হচ্ছে, প্রয়োজনীয় উপকরণ ও যন্ত্রপাতির মাধ্যমে “আধ্যাতিক রেখা” অঙ্কনকে আরবী ক্যালিগ্রাফি বলে। ইংরেজিতে একে স্পিরিচুয়াল জিওমেট্রি বলা হয়েছে। তুর্কি ভাষায় যাকে রুহী হান্দেজ বলে। নন্দনতাত্ত্বিক এই সংজ্ঞা কালের পরিক্রমায় সত্য বলে বিবেচিত হয়েছে। হরফের পর হরফ বসিয়ে এবং হরফের নানান রূপের ব্যবহারে একটি ক্যালিগ্রাফি সার্থকভাবে আধ্যাতিক ভাব প্রাকাশ করে। আরবী হরফের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে কোন হরফ শব্দের প্রথমে, মধ্যে এবং শেষে ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়। শৈল্পিক বিচারে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শিল্পকর্মে এর প্রয়োগ সর্বোচ্চ সৌন্দর্যমন্ডিত হয়ে থাকে। একই শব্দ বিভিন্নভাবে লেখা যায়। আকৃতিগত ভিন্নতার জন্য একই শব্দে ইচ্ছেমত মনের মাধুরী মিশিয়ে কম্পোজিশন ও সৌন্দর্যগত ভেরিয়েশন আনা যায়। এছাড়া শব্দের মধ্যে শব্দ বিনুনী স্টাইল কিংবা ঝুলন্ত স্টাইলে সাজানো যায়। এতে করে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কিংবা ইচ্ছে মত ছন্দ ও ভারসাম্য বজায় রেখে ক্যালিগ্রাফি শিল্প কর্ম তৈরি সম্ভব। একই স্টাইলে একটিশব্দকে বহমাত্রিক ব্যঞ্জনায় উপস্থাপনের অবকাশ থাকায় একজন ক্যালিগ্রাফি শিল্পী তার অন্তর নিহিত আধ্যাত্মিক অনুভব এর প্রয়োগ সময়ে দিতে পারেন। মানুষের মাঝে ক্যালিগ্রাফি অলৌকিক কর্মকান্ড হিসেবে যেমন বিবেচিত, তেমনি বরাবরই এ শিল্প ধর্মীয় আনুকূল্য লাভ করে এসেছে। এর সাথে পূণ্য লাভের বিষয়, মানসিক প্রশান্তি, বিপদাপদ থেকে মুক্তির সহায়ও কেউ কেউ মনে করে থাকেন। কয়েক হিজরী শতাব্দী পর আরবী ক্যালিগ্রাফি ইসলামী ক্যালিগ্রাফিরূপে পরিচিতি লাভ করেছে। এবং ইসলামী ক্যালিগ্রাফিকেই বুঝানো হয়। আরবী ক্যালিগ্রাফির প্রয়োগ সুবিধা, নান্দনিক মান বা এসথেটিক ভেলু এবং আললাহর বাণী কুরআনের বাহন হওয়ায় এটা বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। আমরা গবেষকগণের মাধ্যমে জেনেছি নাবাতীয় হরফ থেকে আরবী হরফের উৎপত্তি কিংবা আম্বর, হিরা অঞ্চলের বিশেষ প্রভাব অথবা ফিনিশিয় হরফের গোত্রভুক্ত আরবী হরফ পবিত্র কুরআনের লিপি হওয়ায় এটি বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। ধীরে ধীরে মক্বী মাদানী লিপি হিসেবে কুফী লিপির গোলায়িত ও ঋজু ধারায় কুরআনের অসংখ্য অনুলিপি তৈরি হয়। এভাবে বড় মাপের নীবের থেকে বিভিন্ন মাপের কলম তৈরি হয়। ফলে নিসফ বা অর্ধেক, সুলুস বা এক তৃতীয়াংশ যাকে কালিমুন নিসফ অর্থাৎ অর্ধেক কলম, হাফিফুন নিসফ বা এক-তৃতীয়াংশ হাফিফুন সুলুস বা দুই তৃতীয়াংশ মাপের কলম দিওয় লেখা হয়। স্টাইলের নামকরণও তেমনি হয়। নির্দিষ্ট মাপের কাগজে লেখা বাধ্যতামূলক করা হয় শৈলীর বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য। উমাইয়া আমলেই এই উন্নয়ন সাধন হয়। এরপর আব্বাসীয় আমলে ক্যালিগ্রাফি মূলত: আর্টিস্টিক ধারায় প্রবাহিত হওয়া শুরু হয়। এ সময় কুরআনের কপিগুলোতে অলংকরণ শুরু হয়। তুর্কী ক্যালিগ্রাফাররা এ কাজে যথেষ্ট অবদান রাখেন। এর ভেতর মুহাক্বাক লিপি যেটি ইরাকী নামেও পরিচিত ছিল। ইবনে মুকলার (মৃ. ৯৪০ খৃ.) আনুপাতিক লেখনীর মাধ্যমে এর উন্নয়ন স্বর্ণশিখরে আরোহণ করে। আধুনিক তুর্কী ক্যালিগ্রাফি শিল্পকলার ট্রেডিশনাল ধারায় একটি অসাধারণ ভূমিকা রেখে চলেছে। প্রতিনিয়ত এই ধারা উন্নতি করছে। তুরস্কে এ বিষয়ে বছরের প্রায় সবটা সময় জুড়েই অসংখ্য কোর্সের আয়োজন হয়। ক্যালিগ্রাফির সাথে সংশি¬ষ্ট অলংকরণ বা যুখরুফাহ আরাবিয়া, স্বর্ণমন্ডন বা গিল্ডিং, কাগজের বর্ডার ডিজাইন, কাগজ মারবেলিং, মিনিয়েচার পেইন্টিং এবং তুর্কী সঙ্গীতও এর সাথে জড়িত। তুর্কি ভাষায় আরবী ক্যালিগ্রাফির তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক বিষয়ে অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করা হয়েছে। সাম্প্রতিক প্রকাশিত ক্যালিগ্রাফির এমন একটি চমৎকার গ্রন্থ হচ্ছে “রুহী হান্দেজ” (¯িপ্ররিচুয়াল জিওমেট্রি)। তুর্কি লেখক সেলিম তুর্কোগলু তুরস্কের ক্যালিগ্রাফিতে যেসব শূন্যস্থান রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র আঁকার প্রয়াস পেয়েছেন তার এই গ্রন্থটিতে। তার এই গ্রন্থটির নামকরণও সেই উদ্দেশ্যকে লক্ষ্য করে দেয়া। প্রাচীন গবেষকরা যেমন ক্যালিগ্রাফিকে ¯িপরিচুয়াল জিওমেট্রি বলেছেন, সেলিম ও তার গ্রন্থটিতে বিষয়টি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। ক্যালিগ্রাফি পরিপূর্ণ শিল্প, সেটা খারে কলমের অন্তরনিহিত গতি প্রকৃতির মাধ্যমে প্রকাশ পায়। সেলিম বিষয়টিকে যথাযথভাবে তার বইতে বর্ণনা করেছেন। তিনি আব্বাসীয় আমলের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার ইয়াকুত আল মুস্তাসীমীর (মৃত্যু-১২৯৮ খৃঃ) জীবনী আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, মুস্তাসীমী নানান কর্মকান্ড ও শিল্পকর্ম তৈরীর পাশাপাশি এক হাজার পবিত্র কুরআনের অনুলিপি তৈরি করেছেন। বিষয়টি অত্যন্ত আশ্চর্যের। কারণ শতখানেক কুরআন অনুলিপি করেছেন এমন ক্যালিগ্রাফার যেখানে খুঁজে পাওয়া দুস্কর, সেখানে একহাজার কপি লেখা আসলেই অলৌকিক ব্যাপার। সেলিম তার গ্রন্থটি ক্যালিগ্রাফির একটি নমুনা দিয়ে শুরু করেছেন বইটিতে ক্যালিগ্রাফির ইতিহাস, বিভিন্ন শৈলী, লেখার উপকরণ, যন্ত্রপাতি ও তার ব্যবহার এবং প্রতিটি হরফের তত্ত্বীয় আলোচনাসহ হাতে-কলমে লেখার যথাযথ টেকনিক পুংখানুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন। হাতে-কলমে সুলুস ও নেসিহ বা নাসখী লিপির অনুশীলনী বা ড্রিলটি লিখেছেন হাসান রেজা এফেন্দি, তালিক শৈলীর ড্রিলটি লিখেছেন হুলুসাই এফেন্দি এবং রিকা শৈলীটি লিখেছেন মুস্তাফা হালিম এফেন্দি। হাসান রেজা এফেন্দির ড্রিলটি ব্যক্তিগত সংগ্রহ হিসেবে সেলিম তার গ্রন্থে প্রথমবারের মত প্রকাশ করেন। গ্রন্থটির শেষ অধ্যায়ে ইবনে মুকলাহ থেকে আধুনিক ক্যালিগ্রাফির ওস্তাদ আলি আরসালান পর্যন্ত মাস্টার ক্যালিগ্রাফারদের জীবনী লিপিবদ্ধ করেছেন। সেলিম তার গ্রন্থটিতে ক্যালিগ্রাফারদের মর্যাদা ও সামাজিক অবস্থান বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, সুলতান দ্বিতীয় বায়োজীদ সে সময়ের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার শেখ হামদুললাহকে অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন। এতে সমসাময়িক জ্ঞানী-গুণী গবেষকরা হামদুললাহকে ঈর্ষা করতে শুরু করেন। একথা জানতে পেরে সুলতান সে সময়ের সকল গবেষক, স্কলার, বুদ্ধিজীবীকে তার প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানান। শেষ হামদুললাহকেও আসতে অনুরোধ করেন। সবাই প্রাসাদে উপস্থিত হলে সুলতান প্রত্যেকের কাছ থেকে তাদের লিখিত গ্রন্থ নিয়ে দরবারের মধ্যখানে ¯তূপ করেন। এরপর হামদুললাহর হাত থেকে তার হস্তলিখিত পবিত্র কুরআনের কপিটি নিয়ে উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এই কুরআনখানা কি এই ¯তূপের শীর্ষে স্থাপন করবো নাকি ভেতরে ঢুকিয়ে দেবো? তখন সবাই কুরআনের কপিটি গ্রন্থরাজির ¯তূপের শীর্ষে স্থাপনের পক্ষে মত প্রদান করেরন। তখন সুলতান ঐ গ্রন্থরাজির লেখকদের উদ্দেশ্যে বলেন, এই মহাগ্রন্থ আল কুরআন যেমন সম্মানিত ও মর্যাদাবান, এর লিপিকারও তেমনি সম্মানিত ও উচ্চাসনের অধিকারী। সুতরাং আমি আশা করবো, আপনাদের কারো কাছ থেকে যেন এর লিপিকারের প্রতি সামান্যতম অসম্মানের কোন কিছু প্রকাশ না পায়। তুরস্কে প্রতি তিন বছর পরপর ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফির আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এবছরও বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার হাশিম মহিাম্মদ বাগদাদী স্মরণে ৭ম আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতা ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ওআইসি’র গবেষণা কেন্দ্র এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। তুর্কি ক্যালিগ্রাফারদের শিল্পকর্ম সম্পর্কে এ সময়ের তুরস্কের ওস্তাদ ক্যালিগ্রাফার হাসান চালাবী বলেন, দিওয়ানী শৈলীতে যেমন তুর্কী ক্যালিগ্রাফাররা জগদ্বিখ্যাত, তেমনি সুলুস শৈলীতেও তুরস্কের ক্যালিগ্রাফাররা বিশ্বে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে সক্ষ হয়েছেন। আধুনিক ক্যালিগ্রাফিতে বিশেষ করে ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফিতে তুর্কী ক্যালিগ্রাফাররা অসাধারণ অবদান রেখে চলেছেন। ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশে তুর্কী ক্যালিগ্রাফি শিল্পীদের আত্মত্যাগ, কঠোর পরিশ্রম, নিপুণ দক্ষতা ও কর্মকান্ড ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। -মোহাম্মদ আবদুর রহীম

No comments:

Post a Comment