Monday, March 8, 2010

ক্যালিগ্রাফির হরফ




শিল্পকলার প্রাচীন ও প্রধানতম শাখা হচ্ছে ক্যালিগ্রাফি। আমরা জানি হরফ দিয়ে ক্যালিগ্রাফির শিল্পকর্ম নির্মাণ করা হয়। কিন্তু ক্যালিগ্রাফি হরফ আর বইয়ের হরফের মধ্যে কি ধরনের মিল-অমিল থাকে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। শিল্পকলা বিশেষ করে ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পন্ডিতগণ মনে করেন ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্মে ব্যবহৃত হরফ নিয়ে দ্বিবিধ কথা রয়েছে। ট্রেডিশনাল বা দ্রুপদি শৈলী ভিত্তিক ক্যালিগ্রাফিতে হরফের নিখুঁত, দক্ষ ও শৈল্পিক উপস্থাপনই মুখ্য সেখানে অন্যকিছু গৌণ। কিন্তু পেইন্টিংয়ে ক্যালিগ্রাফির শিল্পকর্মটি নানান মাত্রায় এসে থাকে। সেখানে শিল্পীর দর্শন, পেইন্টিংয়ের নীতিমালা এবং ক্যালিগ্রাফির দ্রুপদি উপস্থাপন একত্রে একটি মোহনীয়, মর্মভেদী আবহ তৈরী করে। বিশেষ করে ইসলামী ক্যালিগ্রাফিতে যেখানে আরবী হরফের ব্যবহার করা হয়, সেখানে কুরআন ও হাদীসের বাণী নির্ভর ক্যালিগ্রাফি হলে দ্রুপদি ক্যালিগ্রাফির নীতিমালাসহ উপস্থাপিত বাণীটির নির্ভুল ও নির্ভেজাল বানানরীতি, প্রয়োগরীতি সবকিছু মেনে চলতে হয়। পাকিস্তানে শিল্পকলার গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে ক্যালিগ্রাফি। উর্দুতে ক্যালিগ্রাফিকে বলা হয় খতাতি। মূলতঃ টাইপসাজি বা টাইপ্রোগ্রাফি এবং হরফসাজি বা লেটারিং-এর সমন্বয়ে যখন চমৎকার হরফ ভিত্তিক শিল্পকর্ম তৈরী হয় তখন তাকে খতাতি বা ক্যালিগ্রাফি বলে। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভাল, ফারসী বা চীনা ক্যালিগ্রাফির শিল্পকর্ম হয়ত ঐ ভাষার বহু লোক পড়তে পারে না কিন্তু হরফের নান্দনিক উপস্থাপন তাদেরকে এতটাই আকৃষ্ট করে যে নিজের করে পাবার জন্য তা কিনে নিয়ে বাসা বাড়িতে ঝুলিয়ে রাখে। এর জন্য তাদের হৃদয়ে প্রবল ভালবাসা মমত্ববোধ তৈরী হয়। ইসলামী ক্যালিগ্রাফিতে আরেকটু অগ্রগামিতা রয়েছে। এটি পবিত্র শিল্প হিসেবে দর্শকের কাছে বিবেচিত এবং ক্যালিগ্রাফির শিল্পকর্ম প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় স্থান, বাসাবাড়ী সবখানেই রাখা যায় এবং এর সাথে পুণ্যের বিষয়টিও জড়িত। ক্যালিগ্রাফিকে খোশ নবীশীও বলা হয় উর্দুতে। কারণ এটি গুরু নির্ভর শিল্প। যেখানে প্রতিদিন অনুশীলন, চর্চা চালিয়ে যেতে হয়। হরফের নিখুঁত আকার ও পরিমাপ হৃদয়ে গেঁথে নিয়ে কলমের আচঁড়ে তা প্রকাশ করতে হয়। কলম কাটা যেমন শিখতে হয় তেমনি প্রতিটি দ্রুপদি শৈলীর জন্য আলাদা ধরনের কলম তৈরী করতে হয়। কালি তৈরী ও ব্যবহারের নিয়ম-কানুন শিখতে হয়। সর্বোপরি আধ্যাত্মিক শিল্প হিসেবে একে গণ্য করতে হয়। ওস্তাদ ক্যালিগ্রাফারগণ ছাত্রদের সার্টিফিকেট দেয়ার পর একজন ছাত্র ক্যালিগ্রাফার হিসেবে নিজকে প্রকাশ করতে পারেন নতুবা নয়। ক্যালিগ্রাফিতে নতুন শৈলী উদ্ভাবন ও ক্যালিগ্রাফরের দক্ষতা, খ্যাতি ও জনগণের মধ্যে তার উদ্ভাবিত নতুন শৈলীটি জনপ্রিয়তা অর্জনের বিষয়টি উললেখ্য, যদিও শৈলীটি নিখুঁত ও শৈল্পিক হলো কিন্তু জনগণের মধ্যে সেটা স্থায়ী হলো না, তাহলে নতুন শৈলীটির অপমৃত্যু হতে পারে। কিন্তু কখনও কখনও একটি শৈলী সাময়িক চাপা পড়ে থাকলেও পরে একসময় সেটা দ্বিগুণ জৌলুস নিয়ে ফিরে আসে। আবার এক অঞ্চলের ক্যালিগ্রাফি অন্য অঞ্চলে ততটা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে হয়তো পারছে না। তবে সব জায়গায়ই বইয়ের হরফ ও ক্যালিগ্রাফির হরয়ে পার্থক্য রয়েছে। ক্যালিগ্রাফির হরফ নিয়ে পন্ডিতগণ এক কথায় যা বলেন, তা হচ্ছে বইয়ের হরফ হচ্ছে টাইপোগ্রাফি যাতে লেটারিং একই রকম থাকে এবং একটি আড়ষ্ঠ ভাব থাকে কিন্তু একজন শিল্পী যখন হরফকে নিজের মত করে উপস্থাপন করেন এবং তাতে ছন্দ প্রাঞ্জলভাব ও একটি জীবন্ত আবহ ফুটে ওঠে সেখানেই ক্যালিগ্রাফির হরফের সাথে বইয়ের হরফের পার্থক্য বুঝা যায়। -মোহাম্মদ আবদুর রহীম

No comments:

Post a Comment