সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিম বিশ্বে ইসলামী বিশ্বাস নবতর উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলেছে, এসময়ের আধুনিক মুসলিম সমাজ ক্রমাগত ইসলমের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। মালয়েশিয়ায় এ রকম একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগের বিষয় সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। মাসহাফ নূর ফাতেমা এমনই একটি নজরকাড়া প্রজেক্টের নাম। মালয়েশিয়ার ইয়াইয়াসান রেস্টো (আল বারাকা ফাউন্ডেশন) এই যুগান্তকরী প্রজেক্টটি চালু করেছে। এই প্রজেক্টের উদ্দেশ্য হচ্ছে শুধুমাত্র মহিলা ক্যালিগ্রাফার, কাতিব ও অলংকরন শিল্পী দিয়ে ওসমানীয় লিপী বা নশখী লিপিতে পবিত্র কুরআনের কপি তৈরী করে ছাপানোর ব্যবস্থা করা। যদিও চুড়ান্তভাবে কুরআনের এই প্রজেক্টটির নামকরণ হয়নি। তবু হয়তো একে“বিশ্বাসী মহিলাদের কুরআন” কিংবা “বিশ্বাসী মায়েদের কুরআন” নাম দেয়া হতে পারে। প্রজেক্টটিতে শুধুমাত্র মহিলা ক্যালিগ্রাফার, শিল্পী ও মহিলা হাফিজাহ অর্থাৎ পবিত্র কুরআনের মহিলা হাফেজ, নিরীক্ষক এবং সংশ্লি¬ষ্ট সবাই মহিলা। ইসলামের ইতিহাসেও দেখা গেছে স্পেনের আন্দালুসিয়ায় ৮শ বছর ধরে মুসলমানরা শাসন করেছে। সেখানে প্রায় ২০ হাজার মহিলা ক্যালিগ্রাফার ও কুরআনের লিপিকার ছিল। এদের মধ্যে অনেকে অবশ্য পুরো কুরআন লিপিবদ্ধ করেননি। কর্মকর্তদের মতে, পরিপূর্ণ ভাবে প্রজেক্টের প্রতিটি ক্ষেত্রে মহিলা কর্মি নিয়োগের বিষয় হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই প্রথম উদ্যোগ। বিশেষ করে কুরআন অলংকরণ, স্বর্ণমন্ডনের মত সূহ্ম ও ধৈর্যশীল কাজে মহিলাদের অংশ গ্রহণ একটি উলেল¬খযোগ্য বিষয়। কুরআন প্রজেক্টের কাজের পরিকল্পনার অশং হিসেবে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্ত থেকে ড্রইং ও অলংকরণ সংগ্রহ করা হচ্ছে, যাতে মালয়েশিয়ায় এই প্রজেক্টের প্রথম মাসহাফ বা হাতে লেখা কুরআন কপিটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়। এজন্য যাবতীয় তথ্য সংগ্রহের জন্য পৃথিবীর ম্যাপকে ৮ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আরব বিশ্ব, তুরষ্ক, পাকিস্তান ও ইরান, সাবসারান আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া (প্রধানত ইন্ডিয়া), দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরের উপকুলবর্তী দেশসমূহ ও দুই আমেরিকা। প্রতিটি অঞ্চল বিষেশে গবেষণ করে দেখা গেছে যে, প্রত্যেকটি অঞ্চলের ডিজাইন ও ড্রইং নিজস্ব স্বকীয়তা প্রকাশ করেছে। তবে কিছু সাধারণ স্থাপত্য নকশা ও অলংকরণ সব অঞ্চলেই একই রাখা হয়েছে। ঠিক তেমনিভাবে লতাপাতা ও ফুল নিয়ে গবেষণা করে দেখা গেছে প্রত্যেক অঞ্চলেই কিছু স্থানীয় রোগ-ব্যাধি রয়েছে এবং সেগুলোর প্রতিষেধক হিসেবে স্থানীয় লতাগুল্মফুল ব্যবহার করা হয়। ফাউন্ডেশন অনুরূপ একটি তুলনামুলক গবেষণায় দেখেছে যে, এই রোগের জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে ভিন্ন ভিন্ন লতাগুল্মের ব্যবহার হয়ে থাকে। এতকাল মালয়েশিয়ায় মাসহাফ শরীফের অনুলিপি ও অলংকরণে পুরুষ ক্যলিগ্রাফার ডিজাইনারগণ নিয়োজিত ছিলেন। তাদের তৈরী মাসহাফের বহিফ্রেমটিতে ঢেউয়ের মত অলংকরণ বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। পৃষ্ঠার উপর-নীচের সেকশনেও ভিন্ন ভিন্ন অলংকরণ ব্যবহৃত হয়েছে। মালয়েশিয়ায় অধিকাংশ মাসহাফ শরীফের পৃষ্ঠার পাশে হাদীস ও ব্যাখ্যা ইংরেজী ও মালয় ভাষায় দেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রমী এই কুরআনটিতে শুধুমাত্র মহিলা বিষয়ক আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যা মালয় ভাষায় পৃষ্ঠার পাশে দেয়া হয়েছে। সাবেক রাণী সিতি আয়েশা স্বামী সুলতান সালাউদ্দিন আবদুল আযীয শাহ ইন্তেকালের (২০০২) পূর্ব পর্যন্ত গভীর আগ্রহ নিয়ে এই প্রজেক্টে পৃষ্ঠপোষকতা চালিয়ে যান। তারই অনুপ্রেরণায় ২০০৫সালে এই প্রজেক্ট পূর্ণতা পায়। ২০০০ সালে তেহরানের আন্তর্জাতিক কুরআন প্রদর্শনীতে ফাউন্ডেশন ‘জুঝ আম্মা’ অর্থাৎ ৩০ তম পারার খন্ডটি নিয়ে অংশ গ্রহণ করে। ফাউন্ডেশনের অসাধারণ কর্মোদ্দীপনার জন্য ইরানী প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ খাতামী শ্রেষ্ঠ প্রজেক্টের পুরস্কার প্রদান করেন তাদের। প্রজেক্টের জুঝ আম্মাটি একটি মাস্টারপিস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এছাড়া প্রজেক্টের কর্মপরিষদ সূরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসী, সুরা ইয়াসিন, সুরা আল সাজদাহর আহকাম আত তাজবিদ (পঠন নীতিমালা) সহ ইংরেজি তরজমাও প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। মালয়েশিয়ার এই কুরআন প্রজেক্টের কুরআনের পৃষ্ঠার চারপাশের মার্জিনে ব্যতিক্রমী ধরনের ডিজাইন করা হয়েছে। প্যাটার্ন ডিজাইনে এমন সব মটিফ ব্যবহার করা হয়েছে যেটি পাঠকের হৃদয়ে আলাদা ধরনের প্রভাব ফেলবে এবং সচেতনতার সৃষ্টি করবে, যেমন সুরা আল ফাতিহার চারপাশের বর্ডারে নারকেল গাঝকে মটিফ আকারে প্যাটার্ন করে বসানো হয়েছে। এতে আরবে যেমন খেজুর ফলটি আরববাসীর জীবনযাত্রায় বিশাল প্রভাব ফেলে, তেমনি দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় নারকেলও খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ অঞ্চলের মানুষের জীবনে নারকেল যেমন বিশাল আংশ জুড়ে রয়েছে সুরা ফাতিহাও তেমনি মানব জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও নিরাময়ের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অনুসঙ্গ। এই ম্যাসেজ ও অনুভূতি যাতে পাঠকের হৃদয়ে জেগে ওঠে, সে জন্য এই ধরনের ডিজাইন এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। অনুরূপ ৩০তম পারার বর্ডারে ম্যাঙ্গোস্টিন ফলের ড্রইং দেয়া হয়েছে। এই ফলটিও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে জন্মে থাকে। ফলটির বহির্ত্বক দেখতে ততটা দৃষ্টি নন্দন না হলেও এর খোশার ভেতর ফলটুকু অত্যন্ত সুস্বাদু, মিষ্টি এবং লোভনীয়, ঠিক তেমনিভাবে কেউ কুরআন অধ্যয়নের সাথে সাথে শুধু এর মজাটুকুই পাবেনা বরং ধীরে ধীরে সে এর আধ্যাত্মিক বিষয়ও উপলব্ধি করতে থাকবে। সুরা ইয়াসীনের বর্ডারে তামারিন্দ বা তামার আল হিন্দ অর্থৎ ইন্ডিয়ার খেজুর তেঁতুল গাছের মটিফ ব্যবহার করা হয়েছে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মুসলমানরা বৃহস্পতিবার রাতে এ সুরাটি অধিক একাগ্রতা ও আগ্রহের সাথে তেলাওয়াত করে থাকে। তেতুল যেমন শরীরকে শীতল ও স্নিগ্ধ করে তেমনি সুরা ইয়াসিনও আত্মার প্রশান্তি বয়ে আনে। সুরা সাজদার বর্ডার ডিজাইন করা হয়েছে ধানের মটিফ ব্যবহার করে। ধান মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামের প্রধান খাদ্য ফসল। এ অঞ্চলের জীবন যাত্রা, সংস্কৃতি, কাব্য, প্রবাদ প্রবচনে ধান বিশাল প্রভাব বিস্তার করে আছে। ধানকে এজন্য বাছাই করা হয়েছে যখন ধান পাকে তখন শস্যদানার ভারে শীষ অবনত হয়ে যায়। যেন সে আল¬াহর উদ্দেশ্যে সিজদাবনত। এছাড়া ধান পাকার আগে এর সবুজ আভা হৃদয়কে সিক্ত করে। আয়াতুল কুরসীর বর্ডার ডিজাইন করা হয়েছে লেবু গাছের মটিফ ব্যবহার করে। করণ, লেবু শরীরকে নীরোগ রাখতে বিশেষ ভুমিকা রেখে থাকে। তেমনিভাবে আয়াতুল কুরসী মানব জীবনকে কবালা মুসিবত থেকে হেফাজতে রাখে। পবিত্র কুরআনের এসথেটিক দিকটি যেমন মুসলিম ক্যালিগ্রাফারদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তেমনি আলল¬াহর কালাম হিসেবে এর অলৌকিক প্রভাব মুসলিম সমাজে গভীরভাবে রেখাপাত করে থাকে, সেটা মায়েদের কুরআন ক্যালিগ্রাফি করার এই মালয়েশীয় প্রয়াস থেকে আবারও প্রমাণিত হল। বাংলাদেশে ধীরেধীরে মহিলা ক্যালিগ্রাফার গড়ে উঠছেন তাও আমরা গত একদশক থেকে বিভন্ন কালিগ্রাফি প্রদর্শনীতে উলে¬লখযোগ্য হারে মেয়েদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে জানতে পেরেছি।
বাংলাদেশে যদিও শৈলী বা বিভিন্ন ট্রেডিশনাল ফ্রন্টে মহিলা ক্যালিগ্রাফার পাওয়া কঠিন, তবু ক্যালিগ্রাফি সোসাইটির উদ্যোগে বেশ কয়েকজন মহিলা ইতোমধ্যে ক্যালিগ্রাফির তালিম নিচ্ছেন। আশা করা যায়, আর এক দশক পর বাংলাদেশেও প্রফেশনাল মহিলা ক্যালিগ্রাফার পাওয়া যাবে।-মোহাম্মদ আবদুর রহীম
No comments:
Post a Comment