Monday, March 8, 2010

ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফিতে বাংলাদেশ






বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনে নবপ্রতিষ্ঠিত ভিন্ন যে ধারাটি উজ্জ্বল উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে, সে ধারাটি হচ্ছে ক্যালিগ্রাফি। বাংলাদেশের একাডেমিক শিল্পধারায় যদিও ক্যালিগ্রাফির কথা রয়েছে। তবু কী কারণে যে এত বছর ধরে তা চরম অবহেলা পেয়ে এসেছে সেটা বোধগম্য নয়। চারুকলা পাস অধিকাংশ শিল্পীর ধর্মবিশ্বাস যদিও ইসলাম, কিন্তু তাদের ভেতর ক্যালিগ্রাফির প্রতি তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি। হয়ত ইসলামে প্রাণীচিত্র অঙ্কন নিষিদ্ধ জেনে পুরো শিল্পচর্চাকে তারা ইসলাম বহির্ভূত মনে করেন। অথচ এশিয়ান বিয়েনালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা বিপুল সংখ্যক শিল্পকর্ম কিন্তু ক্যালিগ্রাফি নির্ভর এবং সেটা আরবী ক্যালিগ্রাফি নির্ভর। ১৯৮৬ এর ৩য় বিয়েনাল ও ১২শ বিয়েনাল অর্থাৎ ২০০৬ সালের এই এশীয় দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনীতে গ্রান্ড প্রাইজ পেয়েছে ক্যালিগ্রাফি নির্ভর শিল্পকর্ম। এছাড়া প্রায় প্রতিটি বিয়েনালে বহুসংখ্যক ক্যালিগ্রাফি নির্ভর শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হওয়ার পাশাপাশি অনারেবল মেনশন পুরস্কারও পেয়েছে। ক্যালিগ্রাফি যেহেতু হরফ নির্ভর কলা, সুতরাং পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার হরফে ক্যালিগ্রাফি হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বতন্ত্র শিল্প হিসেবে শুধুমাত্র আরবী ক্যালিগ্রাফি প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। এর প্রধান কারন কারণ আরবী লিপির ছন্দময় গতিপ্রকৃতি নিখুঁত শৈলী ও উপস্থাপন চাতুর্য। সম্প্রতি দুবাইয়ে পরপর দুটি শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী হয়েছে। লন্ডনে, সিউলেও ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীর সংবাদ আমরা পেয়েছি। বাংলাদেশেও ৯ম ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়ে গেল মে ২০০৬। বিশ্বব্যাপী ক্যালিগ্রাফির এই যে প্রচার, প্রসার ও খ্যাতি, সেটা মূলত এর শৈলী ভিত্তিক উপস্থাপনার জন্য।বর্তমাে বাংলাদেশে আরবী ক্যালিগ্রাফির একটি চলমান জোয়ার আমরা প্রত্যক্ষ করছি। এ বিষয়ে দর্শক, শিল্পী, সমালোচক, মিডিয়া, পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান, সংগঠন সবার মাঝে ব্যাপক কৌত’হল ও আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে গত এক দশকে ক্যালিগ্রাফি শিল্পকে পরিণত শিল্পযাত্রা হিসেবে উপস্থাপন করতে দেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পীদের আগ্রহ ও প্রয়াস উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পে শৈলীর বিপরীতে পেইন্টিং বিষয়টি প্রবলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। স্বভাবত এ শিল্পের সাথে জড়িত অধিকাংশ শিল্পী একাডেমিক শিল্পচর্চায় রত কিংবা সৌখিনভাবে প্রচলিত শিল্প সম্পর্কে অবগত, কিন্তু শৈলীগত দিক থেকে পেছনে থাকার মূল কারণ হচ্ছে বাংলাদেশে এ বিষয়ে একাডেমিক শিক্ষার কোন সুযোগ না থাকা। তারপরেও ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফিতে যারা প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন, সংখ্যায় তারা হাতে গোনা হলেও দিন দিন এ সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের টেট্রডিশনাল আরবী ক্যালিগ্রাফি কোন অবস্থানে রয়েছে সে সম্পর্কে যথাযথ মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন। কারণ দেশে ক্যালিগ্রাফির বহু সংখ্যক প্রদর্শনী হলেও এখনো আন্তর্জাতিক কোন প্রদর্শনী হয়নি। সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী আয়োজনের পূর্বে অন্তত শৈলীভিত্তিক কাজে সেই মান থাকাটা সম্মানের পশ্ন হয়ে দেখা দেয়। এ পর্যন্ত দেশে যত গুলো ক্যালিগ্রাফির একক ও দলগত প্রদর্শনী হয়েছে সে সব প্রদর্শনীতে অংশ গ্রহণকারী শিল্পীদের শৈলীভিত্তিক কাজ বিবেচনা করলে বিশেষ করে যারা শৈলীকে গুরুত্ব দিচ্ছেন এমন কয়েকজন শিল্পী হচ্ছেন, শহীদুল্লাহ এফ. বারী, আরিফুর রহমান, বশীর মেসবাহ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া নবীনদের মধ্যে আবু দরদা নুরুল্লাহ, নিসার জামিল ও মোস্তফা আল মারুফের কাজে শৈীৈর বিষয়টি চোখে পড়ার মত। অন্যান্য আরো কয়েকজন রয়েছেন যারা প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন, শৈলী বা ট্রেডিশনাল ধারার বিষয়টি একটু খোলাশা হওয়া প্রয়োজন। আরবী ক্যালিগ্রাফির প্রধান কয়েকটি লিপি হচ্ছে, কুফি, সুলস, নাশখ, দিওয়ানী, ফারেসী প্রভৃতি ও ফারসী ধারার দুটি প্রধান লিপি নাস্তালিক ও শিকাস্তে। এসব লিপির সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা আমাদের সামনে রয়েছে, এখন এসব লিপিতে নতুন করে ক্যালিগ্রাফির শিল্পকর্ম করার যে প্রয়াস ও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে সেটা মূলতঃএর উপস্থাপন কৌশল, সেটা মূলতঃ এর উপস্থাপন কৌমল, কম্পোজিশন ও ভাঙ্গাগড়ার কাজের সাথে নিরীক্ষার প্রয়োগ। সুতরাং নির্দ্টভাবে যদি বলতে হয়, যে কোন শৈলী যেমন ধরা যাক ‘সুলস শৈলী’ এটি বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় ও অলংকার সমৃদ্ধ লিপিধারা। একে সুলতানুল খুতুত বা লিপিসমূহের বাদশাহ ও উম্মুল খুতুত বা লিপিসমূহের বাদশাহ ও উম্মুল খুতুত বা লিপিসমূহের জননী বলা হয়। এর তাশকিল বা অলংকার অথ্যন্ত দৃষ্টি নন্দন ও ছন্দময়। এই লিপিতে বাংলাদেশের শিল্পীদেও সর্বধিক সংখ্যক ক্যালিগ্রাফি রচিত হয়েছে। সুতরাং শিল্পীদের কাজের মূল্যায়ন করতে গেলে এ লিপিটির আক্ষরিক আলোচনা এসে যায়। সত্য কথা বলতে গেলে, ক্যালিগ্রাফি মূলতঃ ওস্তাদ নির্ভর শিল্প, শুধু দেখে দেখে কিংবা বই দেখে শৈলী ভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির শত ভাগ কি অর্ধাংশও আয়ত্ব করা দুস্কর। বাস্তব কথা হচ্ছে একজন ওস্তাদেও কাছে ৗশলীর তালিম নিলে ওয হরফ ছয় যে হরফ ছয় মাসে আয়ত্ব করা যায়, সেটা ওস্তাদ ছাড়া ষোল বছরেও ষাট ভাগ আয়ত্ব হয় না। এর সাথে সংশ্লিষ্ট লিপিশিল্পীরা এবিষয়ে বাস্তব প্রমাণ। প্রতিটি শৈলীর কিছু গোপন টেকনিক ও রহস্য রয়েছে। কলম কাটা, দোয়াতের ব্যবহার, কলম ধরা, কাগজের মাপের সাথে কলমের নীবের মাপ, শৈলীর হরফ, লেখার স্ট্রোক ও তারতীবÑতাহকীব সবই রহস্যময়। এই রহস্য ওস্তাদ ছাত্রদের সামনে হাতে কলম উন্মেচন করেন। ক্যালিগ্রাফির অগ্রদূত ও জনক বলে স্বীকৃত ক্যালিগ্রাফার ইবনেবাওয়াব (মৃ. ১০২২) বলেন যে, তিনি কলম কাটতে আড়ালে চলে যেতেন, যাতে এর রহস্য অন্যদেও কাছে প্রকাশ না পায়। কিখ্যাত ফার্সী ক্যালিগ্রাফার মীর আলী, হেরাত (মৃ. ১৫৫৬) -১ম কিস্তি


-মোহাম্মদ আবদুর রহীম

ইসলামী ক্যালিগ্রাফিতে “মুহাম্মদ (স.)” শব্দের নান্দনিক উপস্থাপন


ইসলামী ক্যালিগ্রাফির ইতিহাস ও ক্রমধারায় পবিত্র কুরআন ও হাদীসের বাণী দিয়ে ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে সব চেয়ে বেশী। আললাহ, মুহাম্মদ ও বিসমিললাহ শব্দ দিয়েও অসংখ্য ক্যালিগ্রাফি করেছেন ক্যালিগ্রাফি শিল্পীগণ। হয়ত এমন একজনও ক্যালিগ্রাফার পাওয়া যাবে না যিনি এসব শব্দ দিয়ে ক্যালিগ্রাফি করেননি। বিশেষ করে ইসলামের নবী মুহাম্মদ (স.) নামটি দিয়ে অসংখ্য ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে। ইসলামে যেহেতু ছবি অঙ্কন নিষিদ্ধ, তাই পবিত্র কুরআন হাদীসের বাণী ও আললাহ, রাসূল, মুহাম্মদ বিসমিললাহ শব্দ দিয়ে শিল্পীগণ আধ্যাত্মিক শিল্পকর্ম নির্মাণে সচেষ্ট হয়েছেন। এতে পুণ্যলাভের আকাক্সক্ষা করেছেন। ইসলামের আবির্ভাবের পর থেকেই বিভিন্ন শৈলী নাশখী, সুলস, কুফী, দিওয়ানী, রিকা, রায়হানী, তালিক, মুহাক্কাক প্রভৃতি আরবী শৈলীর সাথে নাস্তালিক, শিকাস্তে ফারসী শৈলী এবং সিন্দী, মুলতানী উর্দূ শৈলীতে ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য ভাষা ইংরেজী, চিনা, জাপানী এমনকি বাংলা লিপিতেও ক্যালিগ্রাফির প্রয়াস চালানো হয়েছে। রাসূল (স.) বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার, গোত্র প্রধানের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন পত্রের মাধ্যমে। কুফী লিপিতে লেখা এসব পত্রের শেষে একটি সিলমোহরেরছাপ দেয়া হয়েছে, যাতে পর্যায়ক্রমে উপর থেকে নিচে আল্লাহ, বাসূল মোহাম্মদ শব্দ রয়েছে। উল্লেখ্য, কুফী লিপিতে লেখা হয়েছে এসব শব্দ। বলা যায়, ইসলামী ক্যালিগ্রাফিতে মুহাম্মদ শব্দের ব্যবহার সেটাই প্রাচীনতম। এরপর কুফা, হিরা, আম্বও, মক্কা মদীনার ক্যালিগ্রাফারগণ কুফী লিপিতে মুহম্মদ শব্দ দিয়ে অসংখ্য ক্যালিগ্রাফি করেছেন। গোলায়িত ছয়টি ধারা সুলুস, নাশখী, রাইহান, মুহাক্কাক, তাওকী ও রিকার সাথে কুফী লিপি ও বিভিন্ন ভাষার লিপিতে মুহাম্মদ (স.) নামের ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে। ফাতেমী যুগে কায়রোর আল আকশার মসজিদে কুরআনের একটি আয়াতের বৃত্তাকার লেখার মধ্যস্থলে মুহাম্মদ ও আলী কুফী দায়েরাহ লিপিতে লেখা হয়েছে। এছাড়া কুফী মুয়াররাক মাদফুর লিপিতে মুহাম্মদ (স.) ৮ বার লিখা হয়েছে। চমৎকার দৃষ্টিনন্দন এই আটকোণা তারকা সদৃশ ক্যালিগ্রাফিটি করেছেন বিখ্যাত ইরানী ক্যালিগ্রাফার শায়খ ইব্রাহীম ফাদেল মাশহাদানী। ১৩৮৭ হিজরীতে কুফী মাদফুর লিপিতে মুহাম্মদ সাল্লাল্লহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম ক্যালিগ্রাফিটি করেছেন আলহাজ্ব মুহাম্মদ আবদুল কাদের। ৫ কোণা তারকার মত করে ৫ বার মুহাম্মদ (স.) শব্দটি লেখা হয়েছে। ১৩৯৪ হিজরীতে ক্যালিগ্রাফার হাসান হাবাস এটি কুফী মুরাববাআ লিপিতে লিখেছেন। চমৎকার একটি চৌকোণা ক্যালিগ্রাফিতে মুহাম্মদ শব্দটি চারবার লেখা হয়েছে। পটভূমিতে লিপি চাতুর্য্যওে প্রয়োগের ফলে সাদা জমীনে অনুরূপ চারবার আলী লেখা ফুটে উঠেছে। এই বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফিটি করেছেন প্রখ্যাত ক্যালিগ্রাফার কামিল সালমান জাবুরী। সম্ভবত ১৪২০ হিজরীতে এটা লেখা হয়েছে। এ শতাব্দীর বিখ্যাত তুর্কী ক্যালিগ্রাফার আমিন বারিন পত্রপল্লবিত কুফী লিপিতে গোলাকার আকৃতিতে মুহাম্মদ শব্দটি ৫ বার লিখেছেন। কিন্তু একটি মিম থেকে শব্দ ৫টি ফুলের পাপড়ীর মত ছড়িয়ে পড়েছে। এ রকম সুলুস লিপিতে অসংখ্য ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে মুহাম্মদ শব্দটি নিয়ে। অপরাপর আরবী শৈলী রাইহান, মুহাক্কাক, তাওকি, রিকা, নাশখী এবং ফারসী লিপি নাস্তালিক, শিকাস্তে লিপিতে আমরা মুহাম্মদ শব্দ দিয়ে অসংখ্য ক্যালিগ্রাফি দেখতে পাই। বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরাও শুধু আরবী নয় বাংলা লিপিতেও মুহাম্মদ শব্দটি দিয়ে দৃষ্টিনন্দন ক্যালিগ্রাফি করেছেন। রাসূলের (স.) প্রতি ভালবাসা, ভক্তি-শ্রদ্ধা ও প্রেমের নজরানার প্রকাশ করতে গিয়ে এসব ক্যালিগ্রাফি তারা করেছেন বলে ধারণা করা হয়। -মোহাম্মদ আবদুর রহীম

ক্যালিগ্রাফির হরফ




শিল্পকলার প্রাচীন ও প্রধানতম শাখা হচ্ছে ক্যালিগ্রাফি। আমরা জানি হরফ দিয়ে ক্যালিগ্রাফির শিল্পকর্ম নির্মাণ করা হয়। কিন্তু ক্যালিগ্রাফি হরফ আর বইয়ের হরফের মধ্যে কি ধরনের মিল-অমিল থাকে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। শিল্পকলা বিশেষ করে ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পন্ডিতগণ মনে করেন ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্মে ব্যবহৃত হরফ নিয়ে দ্বিবিধ কথা রয়েছে। ট্রেডিশনাল বা দ্রুপদি শৈলী ভিত্তিক ক্যালিগ্রাফিতে হরফের নিখুঁত, দক্ষ ও শৈল্পিক উপস্থাপনই মুখ্য সেখানে অন্যকিছু গৌণ। কিন্তু পেইন্টিংয়ে ক্যালিগ্রাফির শিল্পকর্মটি নানান মাত্রায় এসে থাকে। সেখানে শিল্পীর দর্শন, পেইন্টিংয়ের নীতিমালা এবং ক্যালিগ্রাফির দ্রুপদি উপস্থাপন একত্রে একটি মোহনীয়, মর্মভেদী আবহ তৈরী করে। বিশেষ করে ইসলামী ক্যালিগ্রাফিতে যেখানে আরবী হরফের ব্যবহার করা হয়, সেখানে কুরআন ও হাদীসের বাণী নির্ভর ক্যালিগ্রাফি হলে দ্রুপদি ক্যালিগ্রাফির নীতিমালাসহ উপস্থাপিত বাণীটির নির্ভুল ও নির্ভেজাল বানানরীতি, প্রয়োগরীতি সবকিছু মেনে চলতে হয়। পাকিস্তানে শিল্পকলার গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে ক্যালিগ্রাফি। উর্দুতে ক্যালিগ্রাফিকে বলা হয় খতাতি। মূলতঃ টাইপসাজি বা টাইপ্রোগ্রাফি এবং হরফসাজি বা লেটারিং-এর সমন্বয়ে যখন চমৎকার হরফ ভিত্তিক শিল্পকর্ম তৈরী হয় তখন তাকে খতাতি বা ক্যালিগ্রাফি বলে। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভাল, ফারসী বা চীনা ক্যালিগ্রাফির শিল্পকর্ম হয়ত ঐ ভাষার বহু লোক পড়তে পারে না কিন্তু হরফের নান্দনিক উপস্থাপন তাদেরকে এতটাই আকৃষ্ট করে যে নিজের করে পাবার জন্য তা কিনে নিয়ে বাসা বাড়িতে ঝুলিয়ে রাখে। এর জন্য তাদের হৃদয়ে প্রবল ভালবাসা মমত্ববোধ তৈরী হয়। ইসলামী ক্যালিগ্রাফিতে আরেকটু অগ্রগামিতা রয়েছে। এটি পবিত্র শিল্প হিসেবে দর্শকের কাছে বিবেচিত এবং ক্যালিগ্রাফির শিল্পকর্ম প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় স্থান, বাসাবাড়ী সবখানেই রাখা যায় এবং এর সাথে পুণ্যের বিষয়টিও জড়িত। ক্যালিগ্রাফিকে খোশ নবীশীও বলা হয় উর্দুতে। কারণ এটি গুরু নির্ভর শিল্প। যেখানে প্রতিদিন অনুশীলন, চর্চা চালিয়ে যেতে হয়। হরফের নিখুঁত আকার ও পরিমাপ হৃদয়ে গেঁথে নিয়ে কলমের আচঁড়ে তা প্রকাশ করতে হয়। কলম কাটা যেমন শিখতে হয় তেমনি প্রতিটি দ্রুপদি শৈলীর জন্য আলাদা ধরনের কলম তৈরী করতে হয়। কালি তৈরী ও ব্যবহারের নিয়ম-কানুন শিখতে হয়। সর্বোপরি আধ্যাত্মিক শিল্প হিসেবে একে গণ্য করতে হয়। ওস্তাদ ক্যালিগ্রাফারগণ ছাত্রদের সার্টিফিকেট দেয়ার পর একজন ছাত্র ক্যালিগ্রাফার হিসেবে নিজকে প্রকাশ করতে পারেন নতুবা নয়। ক্যালিগ্রাফিতে নতুন শৈলী উদ্ভাবন ও ক্যালিগ্রাফরের দক্ষতা, খ্যাতি ও জনগণের মধ্যে তার উদ্ভাবিত নতুন শৈলীটি জনপ্রিয়তা অর্জনের বিষয়টি উললেখ্য, যদিও শৈলীটি নিখুঁত ও শৈল্পিক হলো কিন্তু জনগণের মধ্যে সেটা স্থায়ী হলো না, তাহলে নতুন শৈলীটির অপমৃত্যু হতে পারে। কিন্তু কখনও কখনও একটি শৈলী সাময়িক চাপা পড়ে থাকলেও পরে একসময় সেটা দ্বিগুণ জৌলুস নিয়ে ফিরে আসে। আবার এক অঞ্চলের ক্যালিগ্রাফি অন্য অঞ্চলে ততটা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে হয়তো পারছে না। তবে সব জায়গায়ই বইয়ের হরফ ও ক্যালিগ্রাফির হরয়ে পার্থক্য রয়েছে। ক্যালিগ্রাফির হরফ নিয়ে পন্ডিতগণ এক কথায় যা বলেন, তা হচ্ছে বইয়ের হরফ হচ্ছে টাইপোগ্রাফি যাতে লেটারিং একই রকম থাকে এবং একটি আড়ষ্ঠ ভাব থাকে কিন্তু একজন শিল্পী যখন হরফকে নিজের মত করে উপস্থাপন করেন এবং তাতে ছন্দ প্রাঞ্জলভাব ও একটি জীবন্ত আবহ ফুটে ওঠে সেখানেই ক্যালিগ্রাফির হরফের সাথে বইয়ের হরফের পার্থক্য বুঝা যায়। -মোহাম্মদ আবদুর রহীম

ভারতে সাম্প্রতিক ক্যালিগ্রাফি চর্চা




ভারতের দিললীর একজন বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন উর্দু ক্যালিগ্রাফার হচ্ছেন আবদুল বাসিত হাশমী। ৫৫ বছর ধরে তিনি এই শিল্পময় হস্তলিপি চর্চা করছেন। ৭২ বছর বয়সী এই লিপিশিল্পী তার জীবনের প্রায় পুরোটা সময় লিপিচর্চার কাজে কাটিয়ে দিয়েছেন, দিললী জামে মসজিদের চত্বরের এক কোনে তাকে বসে থাকতে দেখা যায় আগ্রহী ক্রেতাদের জন্য। হয়ত কদাচিৎ কেউ আগ্রজ করে তার কাছ থেকে বিয়ের কার্ড, পোস্টার কিংবা কোন প্রচারপত্র বা মানপত্র লিখিয়ে নেয়। সন্ধ্যা হলে তিনি সরঞ্জাম গোছাতে গোছাতে স্বাগত কন্ঠে বলে ওঠেন, আগামী দিনটি যেন শূন্যতায় না কাটে। এটা তার নিঃসঙ্গতার চিত্র শুধু একার নয়। উর্দু ক্যালিগ্রাফি যাকে কিতাবাত বা খতাতী বলে দিললীবাসী ভালো জানে। যখন দশক দুই আগে দিললীতে কম্পিউটার এলো, তখন থেকে কিতাবাত পেশায় নিয়োজিতদের রুটি রুজিতে মারাত্মক প্রভাব দেখা দিল। মানুষ তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় লেখা লেখির কাজগুলো কম্পিউটার থেকে লিখে নিতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে লাগলো। কম্পিউটারে উর্দু ফন্টের ক্যালিগ্রাফিক চারিত্র পেশাদার কাতিবদের রোজগারে দারুন সংকট সৃষ্টি করেছে। সুতরাং নতুন প্রজন্ম হাতের লেখার প্রতি আগ্রহ হারিয়েছে বলে হাশমী মন্তব্য করেন। আমরা জানি ক্যালিগ্রাফি শব্দটি গ্রীক ক্যালোস অর্থাৎ সুন্দর এবং গ্রাফোস অর্থাৎ লেখা এর সমন্বয় হস্তলিপিকলা। প্রাত্যহিক কাজে ব্যবহৃত লিপি এবং হস্তলিপিকে ফাইন আর্ট বা ধ্রƒপদি কলায় প্রকাশ করার মাধ্যমে এটি জনগণের হৃদয়ে স্থানলাভ করেছে। ভারতে ক্যালিগ্রাফির কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন ধারা ও স্টাইল রয়েছে। পূর্ব এশিয়ান, তিব্বতী, ইসলামিক ও পশ্চিমা ধারা। ঐতিহাসিকরা বলছেন, হরপ্পা, মহেনজোদারো আর অশোকান আমলের স্থাপত্যে যে লিপিচিত্র উৎকীর্ণ রয়েছে তাই ভারতের প্রাচীন ক্যালিগ্রাফির নমুনা। আর দিললীতে ইসলামিক ক্যালিগ্রাফির পত্তন ও প্রসার ঘটান মোঘল শাসকরা। সাম্প্রতিক ভারতের ক্যালিগ্রাফি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন এ সময়ের খ্যাতিমান ক্যালিগ্রাফার আনিস সিদ্দিকী। তিনি ভারতের প্রাচীন এই শিল্পটি সম্পর্কে বলেন, ক্যালিগ্রাফির মত পবিত্র ও হৃদয়গ্রাহী শিল্পটি এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে দিনাতিপাত করছে। কারণ এর পেছনে কোন পৃষ্ঠপোষক নেই। তিনি নিজেও খুব খারাপ সময় অতিক্রম করেছেন বলে মন্তব্য করেন। তবে ক্যালিগ্রাফির উজ্জ্বল সময়ের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ১৮৫৭ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার মির পাঞ্জা কাশ, হিরালাল জয়পুরী, মুহাম্মদ ইউসুফ দিললীভি, যিনি দেশভাগের সময় পাকিস্তান চলে গিয়েছেন, মুন্সী ইয়াকুব সাহারানপুরী হাল আমলের উললে যোগ্য ক্যালিগ্রাফার। সিদ্দিকী বলেন, এখনও রাষ্ট্রপতি ভবনে গেলে মুহাম্মদ ইউসুফ দিললীভির শিল্পকর্ম দেখা যাবে। মুগল আমলের অবসান ও ইংরেজদের ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে ভারতে উর্দু ক্যালিগ্রাফির দূর্গতি শুরু হয়। দিললীতে এর প্রভাব পড়ে সবচেয়ে বেশী। ইংরেজরা সরাসরি ইংরেজী ক্যালিগ্রাফির জন্য সরকারীভাবে অর্থ সহায়তা দিতে থাকে এবং উর্দু-আরবী ক্যালিগ্রাফির জন্য নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বৃটিশ সরকার ইউরোপ থেকে বহু ইংরেজ ক্যালিগ্রাফা কে নিয়ে আসে এবং তাদের সরকারীভাবে নিয়োগ দেয়া হয়। ফলে উর্দু ক্যালিগ্রাফি মৃত্যু মুখে পতিত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে উর্দু ক্যালিগ্রাফির পুনর্জাগরণে বেসরকারীভাবে প্রয়াস লক্ষণীয়। সারা ভারতে ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর প্রোমশন অফ উর্দু ল্যাঙ্গুয়েজ (এনসিপিইউএল) ১৪টি কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে ক্যালিগ্রাফি প্রশিক্ষণের কাজ শুরু করেছে। এর একটি কেন্দ্র পূর্ব দিললীর সাদারায় বেশ সাড়া জাগিয়েছে। এছাড়া উর্দু একাডেমী ২ বছরের ক্যালিগ্রাফি কোর্স চালু করেছে। এই কোর্সের ৩০ জন ছাত্র একই সাথে ক্যালিগ্রাফি ও ডিজাইন সফটওয়ার শিখছে। সিদ্দিকীও সারিতা বিহারে একটি ক্যালিগ্রাফি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করেছেন। তিনি বলেন, কেউ যেন কম্পিউটারকে দোষ দিতে না পারে। এজন্য কম্পিউটার ও ক্যালিগ্রাফি একত্রে শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা নিয়েছি। সিদ্দিকী ক্যালিগ্রাফির ওপর গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। কম্পিউটারের ব্যবহারের সীমাবদ্ধতার কথা উললেখ করে বলেন, কম্পিউটারে উর্দু ক্যালিগ্রাফির সাধারণ টেক্স ব্যবহার করা সহজ এবং সাধারণ লেখার জন্য এটা খুবই উপযোগী অন্যদিকে খতাতি, যেটা ক্যালিগ্রাফারদের ছাড়া শুধু কম্পিউটার দিয়ে সম্ভব নয়। একজন ক্যালিগ্রাফারই পারেন কম্পিউটার ব্যবহার করে যথাযথ ক্যালিগ্রাফি করতে। সেক্ষেতেও রিড বা খাগের কলম হচ্ছে মূল মাধ্যম। কারণ সাধারণ মানুষ খাগের কলম ব্যবহারে পারদর্শী নয়। সুতরাং তারা কখনও ক্যালিগ্রাফারদের সমতুল্য হতে পারেনা। সাধারণ মানুষ এমনকি চারুকলার বহু শিল্পী ও কিতাবাত ও খতাতী একই বিষয় মনে করেন। কিন্তু আসলে তা নয়। আপনি কোন খতাতী াশল্পকর্ম দেখলেন। ভাষাটা আপনার জানা না থাকলেও দৃষ্টি নন্দন বিষয়ের জন্য সেটাতে আপনি আকৃষ্ট হতে পারেন। যেমন ধরুন একটি কুরআনের বাণীর ক্যালিগ্রাফি বা খতাতী আপনি দেখলেন, আরবী ভাষা কিংবা শিল্পকর্মে উপস্থাপিত লিপিটির মর্মোদ্ধার আপনি তাৎক্ষণিকভাবে করতে পারলেন না। কিন্তু এর প্রয়োগরীতি উপস্থাপন কৌশল ও সূক্ষ্ম শিল্পবোধ আপনার হৃদয়কে আলোড়িত করবে আপনি এত মুগ্ধ হবেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কোন কোন অনুভবে। সিদ্দিকী অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেন যে, ক্যালিগ্রাফিতে প্রাচীনকাল থেকে সাম্প্রতিক সময়েও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রীড পেন বা খাগের কলম। সারা পৃথিবীতে মানুষ ক্যালিগ্রাফির শিক্ষা গ্রহণ করে খাগের কলমের মাধ্যমে। কারণ খাগের কলমের কোন বিকল্প আজও বের হয়নি। ভারতে খাগের কলমের প্রায় ৩৫ প্রকারের নাম পাওয়া যায়। যেমন দিললীতে এক সারকান্দা, পাঞ্জাবে একে কান্না এবং পশ্চিম বাংলায় একে কাতপথী নামে ডাকা হয়। ভারতে নব উত্থান পর্ব চলছে ক্যালিগ্রাফির। সিদ্দিকী মনে করেন, একে সংরক্ষণ ও চলমান রাখতে বিদ্যালয়ে পাঠ্য করা উচিত এবং এটি পেশা হিসেবে স্বীকৃতি ও সরকারীভাবে এর ক্ষেত্র তৈরী করে নিয়োগের ব্যবস্থা করা উচিত। দেখুন, মানুষ এতে আগ্রহী হয় না এজন্য যে এটা পেশা হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। সিদ্দিকী বলেন, দুই দশক ধরে তিনি ক্যালিগ্রাফি চর্চা ও সমাজে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কাজ করছেন, কিন্তু দশ বছর আগেও তিনি এর কোন উজ্জ্বল ভবিষ্যত দেখতে পাননি। এমনকি কোন সুযোগও তিনি পাননি। তিনি উললেখ করেন যে, সম্রাট শাহজাহান, আওরঙ্গজেব এবং বাহাদুর শাহ জাফর দিলেন ভারতের নামকরা ক্যালিগ্রাফার। সম্রাট আকবর ক্যালিগগ্রাফার হিসেবে পরিচিতি না পেলেও শিক্ষাক্ষেত্রে সিলেবাসে ক্যালিগ্রাফিকে বাধ্যতামূলক করেছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের ক্যালিগ্রাফাররা সরকারীভাবে এ শিল্পে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের জোর দাবী জানাচ্ছেন। -মোহাম্মদ আবদুর রহীম

Wednesday, March 3, 2010

দুবাই ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফির ৪র্থ জমজমাট প্রদর্শনী


আরবী ক্যালিগ্রাফি হচ্ছে আরব শিল্পকলার প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটা আরব সভ্যতার প্রাথমিক যুগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং দীর্ঘ ১৪শ বছরের আলোকোজ্জ্বল পথ পাড়ি দিয়ে আরব সভ্যতার আধুনিক পর্যায়ে এসে যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। এটা The core of genuine arts অর্থাৎ প্রকৃত শিল্পকলার শাস এবং অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের উৎস য অনুপ্রেরণা স্বরূপ। বিশেষ করে যুখরুফাহ আল আরাবিয়া বা আরবী নকশাকলা, আরব স্থাপত্য ও পবিত্র কুরআনের অলৌকিক এবং অমীয় বাণী পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার জন্য আরবী ২৮টি হরফ ইসলামী হরফ হিসেবে পরিগণিত হয়। আরবী ক্যালিগ্রাফির প্রতি শুধু প্রশংসা বাণী নয় বরং আরবী হরফের অত্যাশ্চর্য আকৃতি বিশেষ করে যেটা বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অবলম্বন করে প্রয়োগ ও পরিশোধন করা হয়েছে। আরবী হরফের ক্যালিগ্রাফিতে রয়েছে চমৎকার ঐকতান ও সৃজনশীল শৈল্পিক অবকাঠমোগত প্রকাশের ক্ষমতা, পবিত্র কুরআনের কাতিব বা লিপিকার থেকে যা অনুপ্রাণিত হয়ে সহজেই একজন আরবী ক্যালিগ্রাফারের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। আরবী হরফের স্বাভাবিক নমনীয়তা, সৌন্দর্য প্রকাশের সহজাত বৈশিষ্ট্যকে একজন ক্যলিগ্রাফার সফলভাবে প্রয়োগ করে বহুমুখী সৃজনশীল শিল্পকর্ম সেটা ট্রেডিশনাল কিংবা পেইন্টিং অথবা অন্য কোন মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারেন। তবে ট্রেডিশনাল বা শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির যে অন্তর্নিহিত শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে সেটা অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই শুধু খাগের কলমের টানে যে ক্যালিগ্রাফি আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয় সেটাতে অলৌকিক, আধ্যাত্মিক ও স্রষ্টার সাথে রসসিক্ত এক মৌন আলাপনই হৃদয়ে জেগে ওঠে। অনুভবে এক অনাবিল প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফি। দুবাই ডিপার্টমেন্ট অব টুরিজম এন্ড কমার্স মার্কেটিং (ডিটিসিএম) ৪র্থ বারের মত দুবাই আন্তর্জাতিক আরবী ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীর আয়োজন করে। গত ২২ থেকে ২৮ ফেব্র“য়ারি ২০০৭ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত জমজমাট এ প্রদর্শনেিত ৯টি দেশে ২১ জন সমকালীন অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী ক্যালিগ্রাফারের বাছাইকৃত অসাধারণ ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম স্থান পায়। প্রায় সবগুরলা শিল্পকর্মই প্রদর্শনীর প্রথম দু’তিন দিনে বিক্রি হয়ে যায়। সমাপনী অনুষ্ঠানে ইউনাইটেড আরব আমিরাতের সংস্কৃতি, যুব ও সমাজ উন্নয়ন মন্ত্রী আবদুল রহমান আল ওয়াইস বর্তমান সময়ের খ্যাতিমান আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ক্যালিগ্রাফার ও ওস্তাদ তুরস্কের হাসান চালাবীকে বিশেষ এ্যাওয়ার্ড প্রদান করেন। মিজান বা স্বরচিহ্ন বিশিষ্ট এই বিশেষ ট্রফিটি গ্রহণকালে আরো উপস্থিত ছিলেন ডিটিসিএম-এর মহাপরিচালক খালিদ এ বিন সুলাইম। ওআইসির গবেষণা কেন্দ্র কর্তৃক বিশেষ সহযোগিতায় এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। দুবাই এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান শেখ হামদান বিন মুহাম্মদ বিন রশিদ আল মাখতুমের অর্থায়নে এ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী ক্যালিগ্রাফারগণ হলেন--আহমদ আমীন শামতাহ (সিরিয়া), জাওয়াদ খোরান (ইরান), হাকেম গান্নাম (ইরাক), হুসাইন আলী আসিরী আল হামিশী (সৌদি আরব), প্রফেসর ড. খশরু সুরাশি (তুরস্ক), দাউদ বাকতাশ (তুরস্ক), ড. রোদান ভায়াহ (ইরাক), আব্বাস আখাউইন (ইরান), ওসমান ওজচাই (তুরস্ক), মোহাম্মদ জাকারিয়া (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), মোহাম্মদ মানদি (মিশর), নাজিয়া সুবাশি (তুরস্ক), ওসসাম শওকত (ইরাক), ইয়াকুব ইবরাহীম সুলাইমান (জর্ডান) ও আরব আমিরাতের ৪ জন মহিলা ক্যালিগ্রাফার যথাক্রমে ফাতিমা সাঈদ (দুবাই), ফাতিমা মোহাম্মদ আব্দুর রহীম (ইউএই), মাজিদাহ সালিম মুহাম্মদ (শারজাহ) ও নারজিস নূরুদ্দিন (আবুধাবী)। ট্রেডিশনাল আরবী ক্যালিগ্রাফির সুলুস, নাশখ, দিওয়ানী, কুফি, নাস্তালিক প্রভৃতি ধারায় সম্পূর্ণ ঐতিহ্যবাহী কালি দিয়ে এবং ক্যালিগ্রাফির খাগের কলম দিয়ে শিল্পকর্ম করা হয়েছে। প্রদর্শনী উপলক্ষে ৮০ পৃষ্ঠার একটি অসাধারণ ক্যাটালগ প্রকাশ করা হয়। প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের পোটেট ছবি, ক্যালিগ্রা”িফর একটি করে শিল্পকর্মের ছবিসহ এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে বিশিষ্ট ব্যক্তি ও বিখ্যাত সমকালীন ক্যালিগ্রাফারদের মন্তব্যসহ আরবী ক্যালিগ্রাফির ইতিহাস, ক্রমধারা, উন্নয়ন প্রকৃতি নিয়ে প্রামাণ্য চিত্র ও ক্যালিগ্রাফিসহ একটি মহামূল্যবান প্রবন্ধ রয়েছে। বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফি গবেষক ওস্তাদ মুহাম্মদ আবদুরবাহ উলান প্রবন্ধটি লিখেছেন। বাংলাদেশেও ট্রেডিশনাল আরবি ক্যালিগ্রাফির চর্চা শুরু হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে “ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি বাংলাদেশ” নামের সংগঠনটি শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফি শেখাচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলদেশ থেকে এবারই প্রথম তুরস্কে ওআইসি’র গ্রবষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আয়োজিত ৭ম হাশিম মোহাম্মদ আল বাগদাদী শৈলীভিত্তিক আরবী ক্যালিগ্রাফির সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা হয়। ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি বাংলাদেশ এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আহ্বান জানানোর পর ১২ জন নবীন-প্রবীণ ক্যালিগ্রাফি শিল্পী এতে রেজিস্ট্রেশন করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৫ জন প্রতিযোগিতায় শিল্পকর্ম পাঠায়। খাগের বা বাঁশের কঞ্চির কলম দিয়ে, নির্দিষ্ট মাপের নীব ও কাগজে নির্দিষ্ট আয়াত ও টেক্সট, নির্দিষ্ট শৈলীতে শিল্পকর্ম করতে হয়। বিশুদ্ধ শৈলী ও নিপুণ দক্ষতার প্রতিযোগিতা এটি। বাংলাদেশ থেকে অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা হলেন, মোহাম্মদ আবদুর রহীম, সেক্রেটারী ও প্রশিক্ষক ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি বাংলাদেশ, আবুদারদা মোহাম্মদ নূরুললাহ সদস্য ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি, মাসুম বিললাহ, মোরশেদুল আলম ও সিদ্দিকা আফরিন লামিয়া, সদস্য ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি বাংলাদেশ।আরবী ক্যালিগ্রাফির ট্রেডিশনাল বা শৈলীভিত্তিক শিল্পকর্মে ঐতিহ্যবোধ, আধ্যাত্মিকতা ও সর্বোপরি এতে নির্ভজাল শিল্প-সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিকভাবে আজ আরবী ক্যালিগ্রাফি নবতর উদ্দিপনা ও প্রেরণা নিয়ে এগিয়ে চলেছে। দুবাই প্রদর্শনীর মত বাংলাদেশেও ক্যালিগ্রাফির আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী আয়োজনে সরকারি ও বেসরকারিভাবে সবাই এগিয়ে আসবেন এই আহ্বান জানাই। -মোহাম্মদ আবদুর রহীম

আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফি কনটেস্ট ও আমেরিকায় সাম্প্রতিক ক্যালিগ্রাফি চর্চা


১৯৯২ সালে ৩য় আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতার মর্যাদাসম্পন্ন আসরে আমেরিকার মুসলিম ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন। শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমেরিকায় মুসলিম ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরা স্বাতন্ত্র পরিচয় সংরক্ষণে এই প্রতিযোগিতায় নিজেদের শিল্পকর্ম তুলে ধরেন। শুধু আমেরিকাই নয় বিশ্বব্যাপী মুসলিম সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক শৈল্পিক মাধ্যম হচ্ছে ক্যালিগ্রাফি। বিশেষ করে উত্তর আমেরিকার মুসলিম ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরা অনুভব করছেন, মুসলিম সমাজ প্রাত্যহিক জীবন যাত্রায় নানাদিক থেকে পশ্চিমা ও ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রভাবের মুখে নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় সংরক্ষণ করাটা একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে শিল্প ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে এই চ্যালেঞ্জ প্রকট হঢে দেখা দিয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ইসলামের আবির্ভাবের শুরু থেকেই ক্যালিগ্রাফিকে শিল্প বা আর্ট অঙ্গনে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফিপ্রদর্শনীর আয়োজন করে তাকে ইস্তাম্বুলভিত্তিক ইসলামিক হিস্ট্রি, আর্ট ও কালচারের গবেষণা কেন্দ্র। প্রতি তিন বছর পরপর আয়োজিত এই প্রতিযোগিতার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইসলামিক আর্ট হিসেবে ক্যালিগ্রাফির ক্ল্যাসিক ফর্মের উন্নয়নসাধন করা। এর কারণ হচ্ছে, ট্রেডিশনাল স্পিরিটকে বিদেশী প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে মৌলিক নীতিমালা ও বিশুদ্ধ শৈলীর গুণাগুণকে সংরক্ষণ করা। প্রথম আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতা ১৯৮৬ সালে বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার হামিদ আইতাক (হামিদ আল আমিদি) (১৮৯১-১৯৮২) স্মরণে ইস্তাম্বুলে আয়োজন করে রিসার্চ সেন্টার ফর ইসলামিক হিস্ট্রি, আর্ট এন্ড কালচার (আই আর সি আই সি এ)। ১৯৮৯ সালে দ্বিতীয় পতিযোগিতা প্রখ্যাত ক্যালিগ্রাফার ইয়াকুত আল মুস্তাসিমী (মৃত্যু-১৯২৮) স্মরণে, তৃতীয় প্রতিযোগিতা ১৯৯২ সালে ক্যালিগ্রাফির জনক ইবনে আল বাওয়াব (মৃত্যু-১০২২) স্মরণে, চতুর্থ ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতা। (১৯৯৭) শেখ হামদুললাহ (১৪২৯-১৫২০) স্মরণে, পঞ্চম ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতা (২০০০) সাইয়েদ ইবরাহীম (১৮৯৭-১৯৯৪) স্মরণে, ৬ষ্ঠ ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতা (২০০৩) মীর ইমাদ আল হাসেনী (১৫৫৪-১৬১৫) স্মরণে এবং ২০০৬ সালে এবারের ৭ম ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতাটি বিখ্যাতি ক্যালিগ্রাফার হাশিম মুহাম্মদ আল বাগদাদী (১৯১৭-১৯৭৩) স্মরণে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বহুদেশ থেকে ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরা অংশগ্রহণ করছেন। বরাবরের মতো আমেরিকার স্বনামধন্য ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরাও এতে অংশগ্রহণ করছেন। এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে শিল্পীরা অংশগ্রহণ করছেন। ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি বাংলাদেশের উদ্যোগে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত ৭ম আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ থেকে অংশগ্রহণ করছেন ক্যালিগ্রাফি শিল্পী শহীদুললাহ এফ. বারী, আরিফুর রহমান, বসির মেসবাহ, মোহাম্মদ আবদুর রহীম, আমিনুল ইসলাম, নেসার জামিল, আবু দারদা, মোঃ মোরশেদ, মাসুম বিললাহ, ফজলুল হক মারুফ রায়হান ও সিদ্দিকা আফরিন প্রমুখ। তৃতীয় আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতায় আমেরিকা থেকে ৪ জন ক্যালিগ্রাফি শিল্পী পুরস্কার অর্জন করেন। পুরস্কার প্রাপ্তরা হলেন, আবদুল লতীফ মাদাকী, মামুন সাককাল, আবদুল রহমান ইউসুফ ও মুহাম্মদ জাকারিকা। প্রতিযোগিতায় মোট পুরস্কার মূল্য ছিল ৪০ হাজার ২শ ডলার। ১৯টি পুরস্কারসহ ৫৭টি মেনশন ও ৪৮টি ইনসেনটিভ পুরস্কার ছিল। ২৬টি দেশের ৯৬ জন প্রতিযোগী এতে অংশগ্রহণ করেন। একটি সুদৃশ্য ক্যাটালগে এই শিল্পকর্মগুলো প্রকাশ করা হয়। আমেরিকার নিউইয়র্কে বসবাসরত ভারতীয় বংশোদ্ভুত আবদুল লতিফ মাদাকা ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট জালি সুলুস ও জালি দিওয়ানীতে মেনশন পুরস্কার লাভ করেন। মাদাকা ভারতের হায়দারাবাদে শৈশবে ক্যালিগ্রাফিতে দীক্ষালাভ করেন। ১৯৯৩ সালে মাদাকীর একক প্রদর্শনী নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হয়। মামুন সাক্কাল কুফী শৈলীতে প্রথম পুরস্কার অর্জন করেন। সূরা আল বাকারার ১৪৪ নং আয়াতকে তিনি পবিত্র কাবার আদলে উপস্থাপন করেন। তিনি সিরিয়ার আলেপ্পোয় ক্যালিগ্রাফার ইবরাহীম রিফাইয়ের কাছে ক্যালিগ্রাফি শিখেন। ১৯৭৮ সালে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ক্যালিগ্রাফির ওপর অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। গ্রাফিক ডিজাইন ও স্থাপত্য ডিজাইনে তিনি স্থানীয়ভাবে খ্যাতি লাভ করেছেন। এছাড়া মসজিদ ও ধর্মীয় ইমারাতসমূহে তিনি প্রচুর ক্যালিগ্রাফি প্যানেল তৈরি করেছেন। ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণকারী ক্যালিগ্রাফার আবদুল রহমানইউসুফ ১৯৯৩ সালে আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি টেক্সাসের ডালাস থেকে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৯১ সালে এবং ১৯৯৩ সালে দিওয়ানী শৈলীতে মেনশন পুরস্কার লাভ করেন তিনি। ১৯৮৭ সালের প্রথম আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতায় ক্যালিফোর্নিয়ায় জন্মগ্রহণকারী মোহাম্মদ জাকারিয়া জালি সুলুস শৈলীতে একটি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৩ সালে ৩য় প্রতিযোগিতায় তিনি একই শৈলীতে ইনসেনটিভ পুরস্কার লাভ করেন। টিন এজার বয়সে জাকারিয়া ইসলাম গ্রহণ করেন এবং একমাত্র মার্কিন মুসলিম নাগরিক হিসেবে ক্যালিগ্রাফিতে তুর্কী ডিপে¬লামা “ইযাজেত” গ্রহণ করেন। তিনি আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্যালিগ্রাফির ওপর শিক্ষা প্রদান করেন। ক্যালিগ্রাফির ওপর লেখা তার দুটি মূল্যবান গ্রন্থ রয়েছে। বই দু’টির নাম হচ্ছে, দ্যা আর্ট এবং অবজাভেশনস অন ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি। আমেরিকার বহু জাতিক সমাজে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও শিল্পাঙ্গনে ক্যালিগ্রাফি একটি উলেলখযোগ্য স্থান দখল করে রয়েছে, মামুন সাক্কাল ২০০৬ সালের এপ্রিলে আমেরিকায় আরবি ক্যালিগ্রাফি ও টাইপোগ্রাফি বিষয়ক একটি কনফারেন্সের আয়োজন করেন। এ কনফারেন্সে ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকার কয়েকটি দেশ থেকে প্রায় ৩০ জন বিশেষজ্ঞ বক্তব্য রাখেন। এতে একটি ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হয়। বিশ্বের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইসলামী শিল্পকলা সুস্থ, সুন্দর জীবনের পথ দেখায়, ইসলামী কক্যালিগ্রাফিকে অবলম্বন করে আমেরিকার কয়েকজন নিবেদিত প্রাণ মুসলিম শিল্পী নিরলস কাজ করে চলেছেন। সাম্প্রতিক ক্যালিগ্রাফি নিয়ে তাদের এই প্রয়াস ভবিষ্যতে আমেরিকায় ক্যালিগ্রাফিতে উজ্জ্বল পথ রচনা করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। -মোহাম্মদ আবদুর রহীম

তুরস্কের সাম্প্রতিক ক্যালিগ্রাফি চর্চা




তুরস্কের শিল্পকলার ইতিহাসে ক্যালিগ্রাফি একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বিশ্বের শিল্পকলায়ও এর অবস্থান উলেলখ করার মত। আরবী লিপিকলার ইতিহাসে নান্দনিক, ঐতিহ্যিক ও নিজস্বধারা হিসেবে তুরস্কের ক্যালিগ্রাফি সব সময় শিল্পমানকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। বিশেষ করে তুরস্কের ইসলাম প্রবেশ করার মাধ্যমে আরবী লিপির উৎকর্ষ শুরু হয়। ইসলাম রাজশক্তি হিসেবে ১৫১৭ খৃঃ তুরস্কে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ক্যালিগ্রাফিতে দ্রুত উন্নয়ন সাধিত হয়। তুর্কী ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এর উন্নয়নে। আরবী ক্যালিগ্রাফির সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা দিয়েছেন ইসলামী গবেষকরা। সেটা হচ্ছে, প্রয়োজনীয় উপকরণ ও যন্ত্রপাতির মাধ্যমে “আধ্যাতিক রেখা” অঙ্কনকে আরবী ক্যালিগ্রাফি বলে। ইংরেজিতে একে স্পিরিচুয়াল জিওমেট্রি বলা হয়েছে। তুর্কি ভাষায় যাকে রুহী হান্দেজ বলে। নন্দনতাত্ত্বিক এই সংজ্ঞা কালের পরিক্রমায় সত্য বলে বিবেচিত হয়েছে। হরফের পর হরফ বসিয়ে এবং হরফের নানান রূপের ব্যবহারে একটি ক্যালিগ্রাফি সার্থকভাবে আধ্যাতিক ভাব প্রাকাশ করে। আরবী হরফের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে কোন হরফ শব্দের প্রথমে, মধ্যে এবং শেষে ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়। শৈল্পিক বিচারে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শিল্পকর্মে এর প্রয়োগ সর্বোচ্চ সৌন্দর্যমন্ডিত হয়ে থাকে। একই শব্দ বিভিন্নভাবে লেখা যায়। আকৃতিগত ভিন্নতার জন্য একই শব্দে ইচ্ছেমত মনের মাধুরী মিশিয়ে কম্পোজিশন ও সৌন্দর্যগত ভেরিয়েশন আনা যায়। এছাড়া শব্দের মধ্যে শব্দ বিনুনী স্টাইল কিংবা ঝুলন্ত স্টাইলে সাজানো যায়। এতে করে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কিংবা ইচ্ছে মত ছন্দ ও ভারসাম্য বজায় রেখে ক্যালিগ্রাফি শিল্প কর্ম তৈরি সম্ভব। একই স্টাইলে একটিশব্দকে বহমাত্রিক ব্যঞ্জনায় উপস্থাপনের অবকাশ থাকায় একজন ক্যালিগ্রাফি শিল্পী তার অন্তর নিহিত আধ্যাত্মিক অনুভব এর প্রয়োগ সময়ে দিতে পারেন। মানুষের মাঝে ক্যালিগ্রাফি অলৌকিক কর্মকান্ড হিসেবে যেমন বিবেচিত, তেমনি বরাবরই এ শিল্প ধর্মীয় আনুকূল্য লাভ করে এসেছে। এর সাথে পূণ্য লাভের বিষয়, মানসিক প্রশান্তি, বিপদাপদ থেকে মুক্তির সহায়ও কেউ কেউ মনে করে থাকেন। কয়েক হিজরী শতাব্দী পর আরবী ক্যালিগ্রাফি ইসলামী ক্যালিগ্রাফিরূপে পরিচিতি লাভ করেছে। এবং ইসলামী ক্যালিগ্রাফিকেই বুঝানো হয়। আরবী ক্যালিগ্রাফির প্রয়োগ সুবিধা, নান্দনিক মান বা এসথেটিক ভেলু এবং আললাহর বাণী কুরআনের বাহন হওয়ায় এটা বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। আমরা গবেষকগণের মাধ্যমে জেনেছি নাবাতীয় হরফ থেকে আরবী হরফের উৎপত্তি কিংবা আম্বর, হিরা অঞ্চলের বিশেষ প্রভাব অথবা ফিনিশিয় হরফের গোত্রভুক্ত আরবী হরফ পবিত্র কুরআনের লিপি হওয়ায় এটি বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। ধীরে ধীরে মক্বী মাদানী লিপি হিসেবে কুফী লিপির গোলায়িত ও ঋজু ধারায় কুরআনের অসংখ্য অনুলিপি তৈরি হয়। এভাবে বড় মাপের নীবের থেকে বিভিন্ন মাপের কলম তৈরি হয়। ফলে নিসফ বা অর্ধেক, সুলুস বা এক তৃতীয়াংশ যাকে কালিমুন নিসফ অর্থাৎ অর্ধেক কলম, হাফিফুন নিসফ বা এক-তৃতীয়াংশ হাফিফুন সুলুস বা দুই তৃতীয়াংশ মাপের কলম দিওয় লেখা হয়। স্টাইলের নামকরণও তেমনি হয়। নির্দিষ্ট মাপের কাগজে লেখা বাধ্যতামূলক করা হয় শৈলীর বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য। উমাইয়া আমলেই এই উন্নয়ন সাধন হয়। এরপর আব্বাসীয় আমলে ক্যালিগ্রাফি মূলত: আর্টিস্টিক ধারায় প্রবাহিত হওয়া শুরু হয়। এ সময় কুরআনের কপিগুলোতে অলংকরণ শুরু হয়। তুর্কী ক্যালিগ্রাফাররা এ কাজে যথেষ্ট অবদান রাখেন। এর ভেতর মুহাক্বাক লিপি যেটি ইরাকী নামেও পরিচিত ছিল। ইবনে মুকলার (মৃ. ৯৪০ খৃ.) আনুপাতিক লেখনীর মাধ্যমে এর উন্নয়ন স্বর্ণশিখরে আরোহণ করে। আধুনিক তুর্কী ক্যালিগ্রাফি শিল্পকলার ট্রেডিশনাল ধারায় একটি অসাধারণ ভূমিকা রেখে চলেছে। প্রতিনিয়ত এই ধারা উন্নতি করছে। তুরস্কে এ বিষয়ে বছরের প্রায় সবটা সময় জুড়েই অসংখ্য কোর্সের আয়োজন হয়। ক্যালিগ্রাফির সাথে সংশি¬ষ্ট অলংকরণ বা যুখরুফাহ আরাবিয়া, স্বর্ণমন্ডন বা গিল্ডিং, কাগজের বর্ডার ডিজাইন, কাগজ মারবেলিং, মিনিয়েচার পেইন্টিং এবং তুর্কী সঙ্গীতও এর সাথে জড়িত। তুর্কি ভাষায় আরবী ক্যালিগ্রাফির তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক বিষয়ে অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করা হয়েছে। সাম্প্রতিক প্রকাশিত ক্যালিগ্রাফির এমন একটি চমৎকার গ্রন্থ হচ্ছে “রুহী হান্দেজ” (¯িপ্ররিচুয়াল জিওমেট্রি)। তুর্কি লেখক সেলিম তুর্কোগলু তুরস্কের ক্যালিগ্রাফিতে যেসব শূন্যস্থান রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র আঁকার প্রয়াস পেয়েছেন তার এই গ্রন্থটিতে। তার এই গ্রন্থটির নামকরণও সেই উদ্দেশ্যকে লক্ষ্য করে দেয়া। প্রাচীন গবেষকরা যেমন ক্যালিগ্রাফিকে ¯িপরিচুয়াল জিওমেট্রি বলেছেন, সেলিম ও তার গ্রন্থটিতে বিষয়টি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। ক্যালিগ্রাফি পরিপূর্ণ শিল্প, সেটা খারে কলমের অন্তরনিহিত গতি প্রকৃতির মাধ্যমে প্রকাশ পায়। সেলিম বিষয়টিকে যথাযথভাবে তার বইতে বর্ণনা করেছেন। তিনি আব্বাসীয় আমলের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার ইয়াকুত আল মুস্তাসীমীর (মৃত্যু-১২৯৮ খৃঃ) জীবনী আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, মুস্তাসীমী নানান কর্মকান্ড ও শিল্পকর্ম তৈরীর পাশাপাশি এক হাজার পবিত্র কুরআনের অনুলিপি তৈরি করেছেন। বিষয়টি অত্যন্ত আশ্চর্যের। কারণ শতখানেক কুরআন অনুলিপি করেছেন এমন ক্যালিগ্রাফার যেখানে খুঁজে পাওয়া দুস্কর, সেখানে একহাজার কপি লেখা আসলেই অলৌকিক ব্যাপার। সেলিম তার গ্রন্থটি ক্যালিগ্রাফির একটি নমুনা দিয়ে শুরু করেছেন বইটিতে ক্যালিগ্রাফির ইতিহাস, বিভিন্ন শৈলী, লেখার উপকরণ, যন্ত্রপাতি ও তার ব্যবহার এবং প্রতিটি হরফের তত্ত্বীয় আলোচনাসহ হাতে-কলমে লেখার যথাযথ টেকনিক পুংখানুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন। হাতে-কলমে সুলুস ও নেসিহ বা নাসখী লিপির অনুশীলনী বা ড্রিলটি লিখেছেন হাসান রেজা এফেন্দি, তালিক শৈলীর ড্রিলটি লিখেছেন হুলুসাই এফেন্দি এবং রিকা শৈলীটি লিখেছেন মুস্তাফা হালিম এফেন্দি। হাসান রেজা এফেন্দির ড্রিলটি ব্যক্তিগত সংগ্রহ হিসেবে সেলিম তার গ্রন্থে প্রথমবারের মত প্রকাশ করেন। গ্রন্থটির শেষ অধ্যায়ে ইবনে মুকলাহ থেকে আধুনিক ক্যালিগ্রাফির ওস্তাদ আলি আরসালান পর্যন্ত মাস্টার ক্যালিগ্রাফারদের জীবনী লিপিবদ্ধ করেছেন। সেলিম তার গ্রন্থটিতে ক্যালিগ্রাফারদের মর্যাদা ও সামাজিক অবস্থান বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, সুলতান দ্বিতীয় বায়োজীদ সে সময়ের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার শেখ হামদুললাহকে অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন। এতে সমসাময়িক জ্ঞানী-গুণী গবেষকরা হামদুললাহকে ঈর্ষা করতে শুরু করেন। একথা জানতে পেরে সুলতান সে সময়ের সকল গবেষক, স্কলার, বুদ্ধিজীবীকে তার প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানান। শেষ হামদুললাহকেও আসতে অনুরোধ করেন। সবাই প্রাসাদে উপস্থিত হলে সুলতান প্রত্যেকের কাছ থেকে তাদের লিখিত গ্রন্থ নিয়ে দরবারের মধ্যখানে ¯তূপ করেন। এরপর হামদুললাহর হাত থেকে তার হস্তলিখিত পবিত্র কুরআনের কপিটি নিয়ে উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এই কুরআনখানা কি এই ¯তূপের শীর্ষে স্থাপন করবো নাকি ভেতরে ঢুকিয়ে দেবো? তখন সবাই কুরআনের কপিটি গ্রন্থরাজির ¯তূপের শীর্ষে স্থাপনের পক্ষে মত প্রদান করেরন। তখন সুলতান ঐ গ্রন্থরাজির লেখকদের উদ্দেশ্যে বলেন, এই মহাগ্রন্থ আল কুরআন যেমন সম্মানিত ও মর্যাদাবান, এর লিপিকারও তেমনি সম্মানিত ও উচ্চাসনের অধিকারী। সুতরাং আমি আশা করবো, আপনাদের কারো কাছ থেকে যেন এর লিপিকারের প্রতি সামান্যতম অসম্মানের কোন কিছু প্রকাশ না পায়। তুরস্কে প্রতি তিন বছর পরপর ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফির আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এবছরও বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার হাশিম মহিাম্মদ বাগদাদী স্মরণে ৭ম আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতা ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ওআইসি’র গবেষণা কেন্দ্র এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। তুর্কি ক্যালিগ্রাফারদের শিল্পকর্ম সম্পর্কে এ সময়ের তুরস্কের ওস্তাদ ক্যালিগ্রাফার হাসান চালাবী বলেন, দিওয়ানী শৈলীতে যেমন তুর্কী ক্যালিগ্রাফাররা জগদ্বিখ্যাত, তেমনি সুলুস শৈলীতেও তুরস্কের ক্যালিগ্রাফাররা বিশ্বে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে সক্ষ হয়েছেন। আধুনিক ক্যালিগ্রাফিতে বিশেষ করে ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফিতে তুর্কী ক্যালিগ্রাফাররা অসাধারণ অবদান রেখে চলেছেন। ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশে তুর্কী ক্যালিগ্রাফি শিল্পীদের আত্মত্যাগ, কঠোর পরিশ্রম, নিপুণ দক্ষতা ও কর্মকান্ড ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। -মোহাম্মদ আবদুর রহীম

শৈলীবিষয়ক কথকতা


আরবি ক্যালিগ্রাফির প্রাথমিক শৈলীগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, সে সময়ের গবেষক, কাতিব, ক্যালিগ্রাফার বা খাত্তাতদের কাজগুলো কোন শৈলীতে করা হয়েছিল তার একটা স্পষ্ট ধারণা হয়ত আমরা পেতে পারি। কাতিব ও খাত্তাত সম্পর্কে প্রথমে খোলাশা হওয়া প্রয়োজন। কাতিব হচ্ছেন যিনি আরবি লিপিগুলো যথাযথ লিখতে পারেন এবং কিতাব লেখার কাজে পেশাদার হিসেবে কাজ করেন। কাতিব শুধু লেখার কাজটি করেন। খাত্তাত বা ক্যালিগ্রাফার যিনি একাধারে কাতিব ও শৈলীগুলোর সূক্ষ্ম পার্থক্য নিরূপণ করে ছাত্রদের শেখাতে পারেন। নুতন শৈলী আবিষ্কার ও তাতে উন্নয়ন ঘটান, পুরাতন শৈলীতে উন্নয়নের প্রয়াস চালান। যুখরুফাহ আল আরাবিয়া বা নক্সাকলা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখেন। বই বাধাই, বই সংরক্ষণ, বিপণনসহ ক্যালিগ্রাফির যাবতীয় বিষয়ে জ্ঞান রাখেন। এজন্য একজন ক্যালিগ্রাফারের অধীনে বহু কাতিব, নক্সাকার, বাঁধাইকার চাকরি করতেন। এমনকি সেসময় দেশের বড় বড় গ্রন্থাগারের পরিচালক যেমন ক্যালিগ্রাফার ছিলেন। প্রশাসনিক বড় বড় পদেও ক্যালিগ্রাফারকে নিয়োগ দেয়া হতো। কারণ প্রশাসনের উচ্চপদে সৃজনশীল লোকদের নিয়োগ দেয়াটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হত। ক্যালিগ্রাফারগণের প্রত্যেকেই ক্যালিগ্রাফির উন্নয়নে গ্রন্থ রচনা করেছেন। ইতিহাসে এমন কোন ক্যালিগ্রাফার পাওয়া যাবে না যে, তিনি কোন ক্যালিগ্রাফিবিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেননি। ক্যালিগ্রাফির জনক বলে খ্যাত ইবনে মূকলাহ (মৃ. ৯৪০ খৃ.) থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ের নামকরা ক্যালিগ্রাফার বুরসাঈদী পর্যন্ত সমস্ত মাস্টার ক্যালিগ্রাফারই এরকম অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেমন আলী ইবনে হিলাল ইবনে বাওয়াব (মৃ. ১০২২ খৃ.) একটি চমৎকার গ্রন্থ রচনা করেন, যার নাম হচ্ছে “মানসুব আল ফায়েক”, তিনি ক্যালিগ্রাফির বিভিন্ন ধারা, ইস্টালের ওপর মূল সূত্রগুলো রচনা করেন, ইবনে বাওয়াব বলেন, এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে কেউ কোন যাদুর মত বা হুট করে এই শিল্প আয়ত্ত করে চমক দেখাবে। এটা একমাত্র নিরন্তর অনুশীলন, চর্চা ও সঠিক নিয়ম-কানুন মেনে প্রয়াস চালানোর মাধ্যমে আয়ত্ত করা যায়। প্রতিদিন অব্যাহত চর্চার বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন ইবনে বাওয়াব। এর সাথে ক্যালিগ্রাফির সূক্ষ্ম সৌন্দর্যকে আয়ত্ত করার জন্য গোপন কৌশল ওস্তাদের কাছ থেকে জেনে নিয়ে যিনি এর প্রতি গভীর ভালবাসা ও মমত্ব হৃদয়ে ধারণ করে অনুশীলন করবেন তিনি লক্ষ্যে পৌছতে পারবেন। চর্চাকারীকে এর পেছনে নিরন্তর সময় ব্যয় করতে হবে। যখন কেউ ক্যালিগ্রাফির মূলনীতিগুলো আয়ত্ত করে ফলবেন, তখন তাকে মুক্ত হরফ কিংবা যুক্ত হরফ, জড়ানো শব্দ কিংবা টানা লেখা সবখানেই ভারসাম্য, সঠিক আকৃতি, পরিমাপ, ঐকতান ও অনুপাত বজায় রাখার দিকে সবিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। ইবনে বাওয়াব কখখ্যখালিগ্রাফির স্টাইল ও ফন্টের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেয়ার চেয়ে এর যথাযথ চরিত্র রক্ষার দিকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। তিনি কলম কাটার সঠিক পদ্ধতি সহজে কাউকে শেখাতেন না। কারণ এতে শৈলীগুলোর অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা করতেন তিনি। এ সম্পর্কে তিনি একটি কবিতার ছত্র বলতেন।আশা করোনা যে এর গোপনীয়তা আমি প্রকাশ করি। অবশ্যই এর গোপন কৌশল আমি সযতেœ লুকিয়ে রাখি। অগ্রনায়কেরা ক্যালিগ্রাফির হরফকে যথাযথ লেখর প্রতি যেমন গুরুত্ব দিয়ে ছত্রদের শেখাতেন, তেমনি কিভাবে ক্যালিগ্রাফির গোপন সৌন্দর্যগুলো লেখাতে ফুটিয়ে তুলতে হয় সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। এজন্য কয়েকটি মূলনীতি তারা দিয়েছেন। এক হরফকে যথাযথ আকৃতি ও পরিমাপে বারবার অনুশীলন করো যতক্ষণ না সেটা তোমার হৃদয়ে পুরোপুরি বসে যায়। দুই সঠিকভাবে কলম চালনা করো এবং হরফ পূর্ণভাবে লিখো। তিন. অকম্পিত হাতে প্রতিটি স্ট্রোক পূর্ণ করো। চার. প্রতিটি স্টাইলে, লাইনে গ্যাস ও শব্দের শুরু ও শেষ যথা নিয়মে করো। পাঁচ. প্রতি স্টাইলের কম্পোজিশন, লাইন ও বাক্যের শেষপ্রান্ত ও কোণাগুলো খেয়াল করো। একথাগুলো ফন্টের যতগুলো ধারা আছে সবার জন্য প্রযোজ্য। আবু হাউয়ান ইত তাওহীদী (মৃ. ১০১০ খৃ.) সর্বপ্রথম সঠিক ক্যালিগ্রাফি করতে সাতটি য়িম তার “রিসালাহ ফি ইলম আল কিতাবাহ” নামক রচনায় প্রকাশ করে। দুই. ঊর্ধ্বমুখীতাকে যথাযথ প্রয়োগ করো। তিন. গোলায়িত বাক্যগুলোতে অলংকার দাও। চার. লেখার শরুতে চমক দাও। পাঁচ. স্ট্রোকগুলোতে তিক্ষèতা প্রদান করো। ছয়. ফাঁকগুলোও যেন ছন্দময় হয়। সাত. পুরো ক্যালিগ্রাফিতে যথাযথ ধৈর্যসহকারে সম্পন্ন করো। এই নিয়মগুলো হচ্ছে ক্যালিগ্রাফির মূলনীতি এবং লেখার সবগুলো শাখার জন্য এটা প্রযোজ্য। লেখার কৌশলের বর্ণনা এবং লিপিশৈলীর বৈশিষ্ট্যগত বর্ণনা এক বিষয় নয়। এদের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। শৈলীগুলো সম্পর্কে আমরা ধারণা পাই ইবনে আস সাঈগ (মৃ. ১৪৪১ খৃ.) রচিত গ্রন্থে।” তুহফাত উলি আল আলবার ফি সিনাআত আল খাত ওয়া আল কিতাব”গ্রন্থে তিনি বলেন, রিয়াসী শৈলী হচ্ছে মুহাক্বাক-নাসখী শৈলীর কাছাকাছি একটি লিপি। কোন কোন বিশেষজ্ঞ একে তাওকী লিপির নিকটবর্তী একটি লিপি বলে উলে¬লখ করেন। কিন্তু তাওকী লিপিটি বেশি গোলয়িত স্বভাবের। সুতরাং রিয়াসী শৈলীটি মুহাক্বাক-নাসখী শৈলীর নিকটবর্তী বলে মতটি অধিক বিশুদ্ধ। আর যে সময় এই তুলনা করা হয়েছিল তখন তাওকী শৈলীটি সম্পর্কে অনেকেই অবগত ছিলেন না। বরং মুহাক্বাক ও নাসখী লিপিটি অধিক পরিচিতি ছিল। আস সাঈগ তার গ্রন্থের অন্যত্র বলেছেন, তাওকী শৈলীটি অবশ্যই সুলুস লিপি থেকে ছোট হবে। আর সুলুস লিপিটির আলিফ হবে কলমের ছয়টি ফোটা বা নোকতা বরাবর লম্বা। কলমের মোটা-চিকন নীবের প্রশস্ততার জন্য লিপির হরফগুলোর আকৃতি ছোট-বড় হবে। কিন্তু নিয়ম একই থাকবে। মুহাম্মদ ইবনে আল হাসান আত তীবী তার ক্যালিগ্রাফিবিষয়ক গ্রন্থে লিখেছেন, মোটা ও পুষ্টু সুলুস যাকে ‘জালি সুলুস’ বলা হয়। এই সুলুসের উললম্ব ও আনুভূমিক রেখা পুষ্টু ও মোটা হবে এবং এর ইলিফটি সাতটি নোকতা বা ফোটা বরাবর হবে আর খফি বা হালকা ধরনের সুলুস শৈলীতে আলিফটি হবে পাঁচ নোকতা বরাবর লম্বা। গোলয়িত ধারায় এর থেকে ছোট সব শৈলীকে ‘লুলু’ নামে অভিহিত করা হয়। এখানে লুলু শৈলীর কিছু বৈশিষ্ট্য দেয়া হলো,। ১. হরফগেলো আকৃতিতে অবশ্যই স্পষ্ট ও ক্ষুদ্রাকৃতির হতে হবে উলিলখিত লিপিদ্বয় থেকে। অর্থাৎ সুলুস জালি ও খকি থেকে। ২. জিম ও সদৃশ হরফগুলো ডানদিকে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ঝুঁকে থাকবে। ৩. ওয়াও এবং সদুশ হরফগুলো সুস্পষ্টভাবে গোলায়িত হবে। ৪. শুরুর ‘হা’ এবং সৃদশ হরফ প্রশস্ত হবে। ৫. তোয়া এবং সদৃশ হরফের ফাঁসটি ধনুকের মত টান টান বাকানো হবে। ৬. হরফের শেষপ্রান্ত বা স্ট্রোক তীক্ষè হবে। ৭. হরফগুলো প্রত্যেকটি একে অপর থেকে আলাদা হবে, কেউ কারো মধ্যে প্রবিষ্ট হবে না। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে হলে দেখুন নাজি জৈনউদ্দিন রচিত “মুসাওয়ার আল খাত আল আরাবী” নামক গ্রন্থের লুলু শৈলীর অধ্যায়। আত তীবী অবশ্য লুলুকে শেষ শৈলী হিসেবে দেখাননি। তীবী অবশ্য লুলুকে শেষ শৈলী হিসেবে দেখাননি। তিনি সুলুস, মুহাক্বাক ও মুয়ান্নাক শৈলীর মধ্যে পার্থক্য বৃঝাতে নুন, ওয়াও, রা এবং ইয়াকে পৃথক আকৃতির মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।তিনি স্পষ্ট করে বলেন, মুয়ান্নাক অবশ্যই সুলুস ও মুহাক্বাক শৈলীর সমন্বয়ে তৈরি নয়। তবে রাইহানী শৈলী মুহাক্বাক শৈলীর নানা বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছে। এক্ষেত্রে মুহাক্বাক থেকে রাইহান শৈলীর লাইন বা রেখা অধিক সূক্ষ্ম ও প্রশস্ত। সূক্ষ্ম বলতে অবশ্যই রিকা লিপিকে বুঝায়। সুতরাং সাধারণভাবে বর্ণনা দিয়ে স্টাইলগুলো পুরোপুরি বোঝানো সম্ভব নয়। যতটা না হাতে কলমে দেখানো যায়। এজন্যই ওস্তাদ ক্যালিগ্রাফারগণ থিউরীর চেয়ে ব্যবহারিক বা হাতে কলমে ক্যালিগ্রাফি শেখাকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। আততীবী বলেন, মুয়ান্নাক শৈলীতে ক্যালিগ্রাফি করতে যে কলম ব্যবহার করা হয়, একই মাপের কলম দিয়ে “আ‘সার” লিপির ক্যালিগ্রাফি করা যায়। আবার মুহাক্বাক ও নাসখী শৈলীতেও একই মাপের কলম ব্যবহার হয়ে থাকে। এছাড়া মুহাররাফ কলম দিয়ে মুহাক্বাক ও রাইহান লিপি লেখা যায়। মুদাওয়ার কলম দিয়ে রিকা ও তাওকী লিপি লেখা যায়। কিন্তু রিকা ও তাওকী লিপিদ্বয় মুহাক্বাক ও রাইহানী লিপিদ্বয়ের সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্র বৈশিষ্ট্যের। আততীবী তার রচনামালায় শৈলীর বর্ণনা অপেক্ষা কলম কাটা ও কোন কলমে কোন লিপি ভাল লেখা যায় তা বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তার পরেও তার রচনামালার বিভিন্ন স্থানে শৈলীর চরিত্র বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা আমরা দেখে থাকি। তিনি বলেন, রাইহান লিপি ও মুহাক্বাক লিপির অনুপাত হাওয়াশী ও নাসখী লিপির অনুপাতের সদৃশ। এ বর্ণনায় তিনি লিপির হরফের আকার বা সাইজের অনুপাতের কথা বলেছেন, কলমের নয়। এবার আমরা কুফি লিপির জন্য আল কালকাশান্দির (মৃ. ৮২১ হিজরী ১৪২৮ খৃ.) মতামত যাচাই করতে পারি। তিনি কুফি লিপির দুটো উৎসের কথা বলেন, তুমার কলম ও গুবার কলম। অর্থাৎ একটি বৃহদাকৃতির বা প্রশস্ত নীবের এবং অন্যটি ক্ষুদ্রাকৃতি বা ‘সূক্ষ্ম নীবের কলম দিয়ে লেখা হতো। তুমার কলমে লেখা কুফি লিপির চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, তুমার লিপির লাইনাগুলো (ভার্টিকেল ও হরাইজন্টাল) সব সময় সোজা ও তীক্ষè হবে। অন্যদিকে গুবার কলমে লেখা কুফি হবে কিছুটা গোলায়িত লেখার এবং এর ভার্টিকেল বা উললম্ব রেখাগুলো ডানে কিছুটা ঝুঁকে থাকে। এই গুবার কলমের এক তৃতীয়াংশ থেকেই মূলতঃ সুলুস লিপির জন্ম হয়। সুলুস শব্দের অর্থও “এক তৃতীয়াংশ”। এখন একথা হচ্ছে, এসব লিপিতে প্রতিনিয়ত উন্নয়ন ও সংস্কারের প্রয়াস চলেছে এবং সময়ের পরিক্রমায় তা নব নব নিয়ম-কানুন ও টেকনিক অবলম্বন করে এগিয়ে গেছে। এসব লিপি শৈলীর কোনটির উন্নয়ন হয়েছে বিশালভাবে, কোনটিতে তেমন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। আরবি ক্যালিগ্রাফির লিপিগুলোর নাম ও বর্ণনা আমরা চমৎকারভাবে ইবনে আন নাদিমের (মৃত্যু ৯৯৫ খৃ.) আফিহরিস্ত নামক গ্রন্থে দেখতে পাই, আল নাদিমের গ্রন্থে অবশ্য নামই পাওয়া যায় বেশি। যদিও নমুনা তিনি দিয়েছেন তবে ক্যালিগ্রাফির পান্ডুলিপিগুলো থেকে তিনি ততটা নমুনা না নিয়ে নিজেই কিছুটা পার্থক্য দেখিয়েছেন। কুফি লিপি সম্পর্কে জাওয়াদ আলী বলেন, ইরাকী, আনবার ও মাসক লিপির নামকরণে বেশ চাতুর্য রয়েছে, কারণ এগুলো ততটা যুথবদ্ধ নয় বরং এর লেখনরীতি বলা যায় অগোছালো। এটি মুলত: হালকা বৈশিষ্ট্যের বলেই এই নামকরণ করা হয়েছে, কারণ এলাকাভিত্তিক লিপির নামকরণের জন্যই সহজে এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ক্যালিড়্রাফারগণ বুঝতে পারতেন। হালকা ধরনের রেখার আরেকটি শৈলী হচ্ছে ‘জখম লিপি’। কুফি লিপির এই ধারায় বেশকিছু ভিন্ন ও পৃথক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ইরাকের হিরার অধিবাসীরা এই লিপিতে প্রচুর কুরআন অনুলিপি করেছেন। জাওয়াদ আলী এ বিষয়ে তার আল মুফাসসাল গ্রন্থে বিস্তারিত লিখেছেন। জৈনদ্দিন নাজি তার বিদাইয়াশ খত ওয়া খত্তাতীন গ্রন্থে ৮ম শতাব্দীর কয়েকজন তুর্কী ক্যালিগ্রাফারের কথা লিখেছেন। যারা বাগদাদের ইয়াকুত আল মুস্তাসীমীর নীতিমালা অনুসরণ করে ক্যালিগ্রাফি করতেন। এই তুর্কী ক্যালিগ্রাফারদের মধ্যে ৬ জনের নাম উলেলখ করা হলো: ১. আবদুললাহ আশ শায়রাফি। তিনি নাশখী লিপিতে খ্যাতি লাভ করেন। ২. আবদুললাহ আরগুন (মৃ. ৭৪২ হি.)। তিনি মুহাক্বাক লিপিতে বিখ্যাত ছিলেন। ৩. ইয়াহ ইয়া আস সুফী (মৃ. ৭৩৯ হি.)। তিনি সুলুস লিপিতে খ্যাতি অর্জন করেন। ইয়াকুত আল মুস্তাসীমীর সরাসরি ছাত্র ছলেন তিনি। ৪. মুবারক শাহ কুতুব (মৃ. ৭৩৫ হি.)। তিনি তাওকী লিপিতে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ৫. মুবারক শাহ আস সুয়ুফী (মৃ. ৭২০ হি.)। রাইহানী লিপিতে খ্যাতি লাভ করেন। ৬. আহমদ আস সুহরাওয়ার্দী তাইয়িব শাহ (মৃ. ৭২০ হি.)। রিকা লিপিতে খ্যাতি অর্জন করেন। এখানে আরেকটি কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি, একটি লিপি এা অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে গিয়ে ভিন্ন নামে কিংবা নামের সামান্য রদবদল যেমন হয়েছে, তেমনি লিপিটিতে সংস্কার ও উন্নয়ন হয়েছে। নাসখী লিপিটি বিশ্বব্যাপী কুরআনের লিপি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে, অঞ্চল ভেদে এর নামও পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। যেমন তুরস্কে একে ‘নেসিহ’ লিপি বলা হয়। ক্যালিগ্রাফারগণ প্রয়োজনবোধে তাদের লিপিটির যথাযথ বর্ণনা লিখে গেছেন, খলিফা আল মামুন নিজে নির্দেশ দিয়ে ‘নিশফ’ লিপিতে সরকারি কাগজপত্র লিখতে বলেন। পরে এর নাম হয় ‘রিয়াসী” বা সরকারি লিপি। আরবি ক্যালিগ্রাফির লিপিশৈলীর গভীরে যেতে হলে লিপিগুলো সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা থাকা প্রয়োজন। আমরা বাংলাভাষী বিধায় আরবি ক্যালিগ্রাফির সূক্ষ্ম শৈলীভিত্তিক পার্থক্য যেমন ধরতে পারি না, তেমনি এর অন্তরনিহিত মজাও পাওয়া যাচ্ছে না, পৃথিবীতে একমাত্র ট্রেডিশনাল আরবি ক্যালিগ্রাফির রয়েছে বিজ্ঞানসম্মত নীতিমালা ও কলাকৌশল। শিল্পের এই দ্রুপদি ধারায় যারা পদচারণা করবেন, যারা এর রস আস্বাদন করতে আগ্রহী, তাদের জন্য এর সম্যক ধারণা অর্জন ব্যতিরেকে সমালোচনা বাতুলতা মাত্র। তবে বাংলাদেশে পৃতিনিয়ত ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফিতে আগ্রহ বাড়ছে বলেই লিপির শৈলীভিত্তিক উৎকর্ষও হচ্ছে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন ক্যালিগ্রাফির প্রদর্শনীতে এর প্রমাণ আমরা প্রত্যক্ষ করছি, এর সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই আরো সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসবেন, এই আশা রাখা যায়। -মোহাম্মদ আবদুর রহীম

বাংলাদেশের ব্যতিক্রমী শিল্পধারা ঃ ক্যালিগ্রাফি


সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি শিল্প একটি ব্যতিক্রমী ধারা হিসেবে আমরা প্রত্যক্ষ করছি। এক যুগ আগেও বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি একটি শিল্প ধারা হিসেবে গড়ে উঠবে এ ধারণা আমাদের কল্পনারও বাইরে ছিল। বর্তমান সময়ে ক্যালিগ্রাফিকে বাংলাদেশে পরিচিত, পুনর্জাগরণ ও প্রতিষ্ঠিত করতে যে কয়জন ক্যালিগ্রাফি শিল্পী অক্লান্ত প্রচেষ্টা অব্যহত রেখেছেন তাদের মধ্যে মোহাম্মদ আবদুর রহীম অন্যতম। এছাড়া ক্যালিগ্রাফির আন্দোলন, সংগঠন ও শিল্পীদের ক্যালিগ্রাফির অঙ্গনে জড়ো করতে শিল্পী ইব্রাহীম মন্ডল বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছেন। এ শিল্পাঙ্গনে আরো যারা ভূমিকা রেখে চলেছেন শিল্পী আরিফুর রহমান, শহীদুল¬লাহ এফ. বারী, সবিহ-উল আলম, মোঃ আমিনুল ইসলাম আমিন, মোবাশ্বের মজুমদার প্রমুখ উলে¬লখযোগ্য। বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি দ’টি ধারায় প্রবাহিত-(১) ট্রেডিশনাল বা দ্রুপদি ধারা (২) পেইন্টিং ক্যালিগ্রাফি। দ্রুপদি ধারায় হাতে গোনা কয়েকজন ক্যালিগ্রাফার রয়েছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে বহুসংখ্যক দলগত ও একক ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জাঁক-জমকপূর্ণ ও বড় প্রদর্শনী হচ্ছে সীরাতুন নবী (সঃ) উপলক্ষে রবিউল আউয়াল মাসে ঢাকা সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র আয়োজিত ও বাংলাদেশ ক্যালিগ্রাফি সোসাইটির সহযোগিতায় যৌথ ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী। এ পর্যন্ত ৯টি প্রদর্শনী তারা আয়োজন করেছে। এ প্রদর্শনীটিই বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফির বাস্তব চিত্র ও অবস্থান প্রকাশ করে থাকে। এই প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত শিল্পকর্ম দেখে বোঝা যায় ট্রেডিশনাল ধারা ও পেইন্টিং ক্যালিগ্রাফির উন্নয়ন বেশ জোরেশোরে বাংলাদেশে হচ্ছে। ট্রেডিশনাল ধারায় বাংলাদেশে যারা উলে¬লখযোগ্য, তারা হলেন শিল্পী শহীদুল¬লাহ এফ. বারী মোহাম্মদ আবদুর রহীম, বশির মেজবাহ ও তরুন শিল্পী আবু দারদা নূরুল¬লাহ প্রমুখ। শিল্পী আরিফুর রহমান ট্রেডিশনাল ধারায় কাজ করার চেষ্টা করলেও তার কোন শিল্পকর্মে ক্যালিগ্রাফির কলমের প্রয়োগ দেখা যায় না। তবে তিনি ট্রেডিশনাল ধারার প্রতি যতœশীল ও আগ্রহী বলে ধারণা হয়। পেইন্টিং ক্যালিগ্রাফিতে শিল্পী মুর্তাজা বশীরের নাম বিশেষভাবে উলে¬লখ করতে হয়। তিনি কালিমা তৈয়্যেবা নামে একটি একক প্রদর্শনী করেছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর গ্যালারিতে। তার এ পেইন্টিং প্রদর্শনী মূলত বাংলাদেশের শিল্পকলায় পেইন্টিংয়ে কিভাবে ক্যালিগ্রাফির উপস্থাপন করতে হয় তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শিল্পী আবু তাহের প্রধান ও খ্যাতিমান শিল্পী, তিনি বিমূর্ত ধারার ক্যালিগ্রাফি নির্মাণ করে থাকেন। শিল্পী সবিহ্-উল আলম- একাধারে লেখক, ডিজাইনার ও শিল্পী। তার ক্যালিগ্রাফি স্কেচ চিত্রকলায় ত্রিমাত্রিক ধারাকে পরিপুষ্ট করেছে। শিল্পী শহীদুল¬লাহ এফ. বারী সউদী আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে ডিগ্রী প্রাপ্ত। এ দেশে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফিতে আন্তর্জাতিক ধারাসমূহ উপস্থাপনে সক্ষম। শিল্পী মোহাম্মদ আবদুর রহীম দীর্ঘদিন ক্যালিগ্রাফি শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত। ক্যালিগ্রাফি চর্চার সাথে সাথে এর ইতিহাস, শৈলী, নন্দনতত্ত্ব, উদ্ভব ও গোড়ার কথা, উপকরণ, কলাকৌশল ও বৈশিষ্ট্য প্রভৃতিকে লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরছেন তিনি। তার ইসলামী ক্যালিগ্রাফি বিষয়ক শতাধিক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া মসজিদ, ধর্মীয় ইমারত ক্যালিগ্রাফি দিয়ে অলংকরণ করেছেন। সিরামিক, কাঠখোদাই, ফুলদানি, কলমদানি, কাঁচ, পটারি, মার্বেল পাথরে এবং তেল রং, পানি রং মাধ্যমে প্রতিটি শিল্পাঙ্গনে তার পদচারণা রয়েছে নিপুণ হাতে। মসজিদ অলংকরণ তার একটি উলে¬লখযোগ্য কাজ। সম্প্রতি (২০০২ খ্রীঃ) চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র বন্দরের ৫নং জেটি গেটের কাছে প্রাচিন একটি মসজিদের পুনঃসংস্কারের পর তিনি ক্যালিগ্রাফি দিয়ে অলংকরণ করেন। মসজিদে ঢুকে সেগুন কাঠের দরজায় চমৎকার ক্যালিগ্রাফি নজরে পড়বে। বৃত্তাকারে দরজার উভয় পাশে চারবার এ ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে। বৃত্তের পরিধি বরাবর দশবার ‘মুহাম্মদ’ ও মাঝে দু’বার ‘আল¬লাহু’ শব্দটি কুফী লিপির নান্দনিক ধারায় খোদাই করে লেখা হয়েছে। এরপর সামনে তাকালে অভিভূত হতে হয় মিহরাবসহ পশ্চিমের দেয়াল দেখে। মিহরাবে তিনি সাদা মার্বেল পাথরে অত্যন্ত চমৎকার করে জ্যামিতিক ফুল-লতা-পাতার নকশা সহকারে কুফি ও সুলুস লিপিতে মেটালিক সবুজ রং দিয়ে ক্যালিগ্রাফি করেছেন। তার এ ক্যালিগ্রাফির সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা না দেখে শুধু বর্ণনায় অনুভব করা সম্ভব নয় এবং তা বর্ণনা করাও বেশ দুরূহ ব্যাপার। মিহরাবের উপরে চতুর্ভুজাকৃতি এ ক্যালিগ্রাফিতে মাঝে ‘আল¬লাজাল¬লা জালালাহু’ সুলুস লিপিতে এবং চার পাশের বাহুতে ও কোণায় যথাক্রমে ‘আল-মুলকু লিললাহ’ ও ‘আললাহ’ চারবার কুফি লিপিতে অলংকরণ সহকারে করা হয়েছে। মিহরাবের দু’পাশে উপরে সবুজ টাইলস কেটে কাবা ও মদীনা মসজিদের গম্বুজের আদলে তুঘরা লিপিতে যথাক্রমে কুরআনের বাণী ‘ওযামুর আহলাকা বিচ্ছালাতি, এবং হাদীসের বাণী ‘আল ইইহসানু আন তা’বুদাললাহ’...দিয়ে চমৎকার ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে। চারপাশের দেয়লে মার্বেল পাথরে মেটালিক সোনালী রংয়ের হরফে সুলুসলিপি স্বতন্ত্র ধারায় ব্যান্ডের মত সূরা আর রহমান লেখা ক্যালিগ্রাফিটি যেন কাবা শরীফের গিলফের ওপর ব্যান্ড করে লেখার কথা স্মরণ করিয়েদেয়। মিহরাবের ডান পাশে সূরার শেষে কালো পাথরে মসজিদের পুনঃসংস্কার দাতা, ক্যালিগ্রাফির সন, তারিখ প্রভৃতি ছোট করে লেখ হয়েছে। দক্ষিন পাশের দেয়ালে আর্চের মত করে সাদা মার্বেল পাথরে কালো কালিতে সূরা সফের আয়াত ‘ইয়া আইয়ু হাললাজিনা আমানু ইয়ানুদিয়া লিসসালাতি....এবং ‘আললাহু আকবার’ ও ‘ইন্নাস সালাতা তানহা ইনিল ফাহশা-ই ওয়াল মুনকার’ আয়াত অর্থসহ সুলুস লিপিতে লেখা হয়েছে। গম্বুজের নিচের দিকে আটটি কাঠের প্যানেলের চারটি আরবি নাশখ লিপির (অলংকরণসহ) চারটি বাংলয় নিশ্চয় আললাহর স্মরণ অন্তরসমূহকে প্রশান্তি দেয়’ বাক্যটি ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে খোদাই করে। আরবি আয়াত হচ্ছে ‘আলা বিযিকরিললাহি তাতমাইনুল কুলুব’। এছাড়াও ২০০০ সালে ঢাকার বারিধারা, ডিওএইচএস জামে মসজিদে কাঠে ক্যালিগ্রাফি করেছেন, মসজিদের ভেতর চারটি পিলরের সিলিংয়ের কাছে মোট ৪৪টি আললাহর গুণবাচক নাম বেঙ্গল তুগরার আধুনিক ধারায় খোদাই করে ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে। দরজার ওপরে মসজিদে প্রবেশ ও বের হওয়ার দোয়া নাশখ লিপিতে খোদাই করে লেখা হয়েছে। মসজিদের ক্যালিগ্রাফির এ শিল্পকর্ম একটি ব্যতিক্রম ধর্মী প্রয়াস। মৃৎপাত্র অলংকরণ তার আর একটি সংযোজন, মধ্যযুগে সালতানাত মোগল আমলের পরে আধুনিক যুগে এদেশে এটাই প্রথম প্রচেষ্টা সিরামিক পটারিতে ক্যালিগ্রাফি অংকন। ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই মুসলমান শিল্পীরা পানির পাত্রকে অলংকরণ করে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে, ফুল, লতা-পাতা জ্যামিতিক নকশা দ্বারা। শিল্পী মোহাম্মদ আবদুর রহীম- সেই ধারাকে তুলে এনে এদেশীয় অলংকরণ ফূল লতা-পাতার মোটিফ ব্যবহার করে গে¬লজ ফায়ারিং এর মাধ্যমে সিরামিক পটারিতে ক্যালিগ্রাফি করেছেন। তার রংয়ের ব্যবহার এখানে আকর্ষণীয় ও রুচিসম্মত। বিশেষ করে কোমল রংয়ের ব্যবহার তার পটারিকে বিশেষিত করেছে। গত ৫ম স্থানে ক্যালিগ্রাফি করেছেন। মসজিদের প্রবেশদ্বারের উপরে মাগরেবি কুফী লিপিতে কুরআনের আয়াত “ইন্নামা ইয়ামুরু মাসাজিদাললাহে মান আমানা বিললাহী ..... মুহতাদিন পর্যন্ত লেখা হয়েছে। জমিনে কয়েকটি হারকা রংয়ের ফুলের নকশা দেওয়া হয়েছে ক্যালিগ্রাফি মোরালটির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ হচ্ছে ১৫ফুট ও আড়াই ফুট। মসজিদের ভিতরে মিহরাবের উপরে জ্যামিতিক কুফী লিপিতে কালেমা তৈয়্যবা লেখা হয়েছে। মিহরাবের ভিতরে ‘আললাহু আকবর’ সুলুস লিপিতে বর্গাকৃতি করে এবং দুই পাশে গম্বুজ আকৃতি করে কুরআনের দুইটি আয়াত লেখা হয়েছে। প্রমত্তাপদ্মার তীর ঘেঁষে নয়নাভিরাম সবুজের বুক চিরে সুন্দর এই মসজিদটিতে ইসলামী সংস্কৃতির ও শিল্পকলার প্রধান উপাদান আরবী ক্যালিগ্রাফির সংযোজনে একে আরো মোহনীয় করে তুলেছে। শিল্পী আবদুর রহীমের আরেকটি উলেলখযোগ্য কাজ হচ্ছে ঢাকা সেনানিবাসে সদর দফতরের সামনে নবনির্মিত আর্মি সেন্ট্রাল মসজিদে ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং। বিশালাকার একটি মাত্র গম্বুজের এই মসজিদের অভন্তরভাগে ১২টি আর্চে ১২টি ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং করেছেন। সুলুস, নাশখি ও দেওয়ানী শৈলির এই ক্যালিগ্রাফিগুলোর জমিনে বাংলার নিসর্গ বিমূর্তভাবে ফুটে উঠেছে। এক্রেলিক রং দিয়ে কাপড়ের ক্যানভাসে এ ধরনের ক্যালিগ্রাফি বাংলদেশের মসজিদে প্রথম প্রয়োগ বলে অনুমিত হয়। মিহরাবের উপরে সুলুস লিপিতে গাঢ় মেজেন্ডা হলুদের মিশ্রণের পটভূমিতে হলুদ রংয়ের কালেমা তৈয়্যেবা চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে। মসজিদে যে কোন ধরনের ক্যালিগ্রাফি সংযোজনে শিল্পী আবদুর রহীম সিদ্ধহস্ত। পাথর, কাঠ, কাঁচ, সিরামিক টাইলস, মেটাল কিংবা ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং দিয়ে মসজিদে প্রচুর ক্যালিগ্রাফির উপস্থাপন তাকে দেশের শীর্ষস্থানীয় ক্যালিগ্রাফি শিল্পীর পর্যায়ে নিয়ে গেছে। শিল্পী মোহাম্মদ আবদুর রহীম সম্পর্কে একটু বেশি আলোচনা করার কারণ হচ্ছে বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির উন্নয়ন, প্রচার প্রসারে তিনি বহুমুখী ভূমিকা রেখে চলেছেন। তাছাড়া আরবি ক্যালিগ্রাফির লিপি শৈলীর গভীরে যেতে হলে লিপিগুলো সম্পর্কে যথাযথ ধারণা থাকা প্রয়োজন। প্রতিভাবান ও প্রতিশ্র“তিশীল ক্যালিগ্রাফার মোহাম্মদ আবদুর রহীম সেগুনেও গুনান্বিত। এরই ফলশ্র“তিতে একেবারে শুরুথেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আরবি লিপি শিল্পের দর্শণ, বৈশিষ্ট্য নান্দনিকতা ব্যাকরণ ইত্যাদি সম্পর্কে তার মনে সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে উঠেছে, যা তাকে ইসলামি ক্যালিগ্রাফি বইটি রচনায় সাহস ও শক্তি যুগিয়েছে। বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি অগ্রযাত্রায় মৌলিক ভূমিকার অংশ হিসেবে একে ধরা যায়। বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি বিষয়ক প্রকাশিত প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ফিচার ইত্যাদি সবগুলো রচনার ৭০ শতাংশেরও বেশি রচনা শিল্পী মোহাম্মদ আবদুর রহীমের হাত থেকে বেরিয়েছে। এছাড়া তিনি ক্যালিগ্রাফি সোসাইটির প্রশিক্ষণ কোর্সের শৈলী বিষয়ক অন্যতম ওস্তাদ। ক্যালিগ্রাফি সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী হিসেবে তিনি ঢাকা সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র আয়োজিত ১৯৯৮ সালে প্রথম যৌথ ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীর সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। দেশে বিদেশে তার ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শিত হয়েছে। বাংলাদেশে মৌলিক ক্যালিগ্রাফি চর্চায় তার অবদান অনস্বীকার্য। মোহাম্মদ আবদুর রহীম শুধু ক্যালিগ্রাফি ¬িশল্পীই নয় এ বিষয়ে তিনি একজন উঁচুমানের গবেষকও বটে। পবিত্র মাহে রামাজান ১৪২৬ হিঃ (২০০৫ ইং) উপলক্ষে বাংলাদেশে আয়োজিত ইরানী কালচারাল সেন্টারের শৈল্পিক দৃষ্টিতে কুরআন প্রদর্শনী উপলক্ষে “বিসমিল¬লাহির রাহমানির রাহীম” শীর্ষক ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তিনি প্রথম পুরস্কার অর্জন করেন। বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি শিল্পে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলারাও উলেলখযোগ্য হারে এগিয়ে এসেছেন। শিল্পী ফেরদাউস আরা আহমেদ, শিল্পী ফেরদউসী বেগম, শিল্পী রেশমা আকতার, শিল্পী নাজমুন সাইদা পোলি, শিল্পী মাসুমা আখতার মিলি, শিল্পী মোসাম্মাৎ মোকাররমা, শিল্পী শর্শিল কাদের প্রমুখ ক্যালিগ্রাফি শিল্পী বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি চর্চায় ব্যতিক্রমী ভূমিকা রেখে চলেছেন। শিল্পী ফেরদাউস আরা আহমেদ মহিলা ক্যলিগ্রাফির শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম। তিনি মেহেদি পাতার রস দিয়ে ক্যালিগ্রাফির শিল্পকর্ম করেন। তিনি এটা দিয়ে পবিত্র কুরআনের একটি কপিও লিখেছেন। আরানের কুরআন প্রদর্শনীতে এবার ২০০৬ সালে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। সেখানে তার মেহেদি পাতার রসে লেখা কুরআন সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। শিল্পী ফেরদাউসী বেগম তার শিল্পকর্মে সূচিকর্মের ব্যবহারে বৈশিষ্ট্য মন্ডিত করেছেন। অন্যান্য মহিলা ক্যালিগ্রাফি শিল্পীও চমৎকার ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং করেন। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয়, মহিলাদের ভেতরে এখনও কোন ট্রেডিশনাল ধারার শিল্পী গড়ে ওঠেনি। তবে আশার কথা হচ্ছে ক্যালিগ্রাফি সোসাইটির প্রশিক্ষণ কোর্সে বেশ কয়েকজন মহিলা ট্রেডিশনাল ধারার শিক্ষা গ্রহণ করছেন। আশা করা যায় আগামী ১০ বছরের মধ্যে ক্যালিগ্রাফি শিল্পে ট্রেডিশনাল ও পেইন্টিং ধারায় মানসম্মত শিল্পীর শিল্পকর্ম দেখতে পাব। ক্যালিগ্রাফি শিল্প সবসময়ই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এসেছে। তাই মুসলিম প্রধান এই দেশের সরকারের পক্ষ থেকেও ক্যালিগ্রাফি শিল্পের উন্নয়ন, প্রচার, প্রসার ও সুদৃঢ় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে এই দাবি ও আশা করছি। এই শিল্পের সাথে সংশি¬লষ্ট লেখক, গবেষক, শিল্পী, সংগঠক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রভৃতির সক্রিয় ভূমিকাকে আরো জোরদার করার আহ্বান জানাই। বিশেষ করে মহিলা শিল্পীরা এতে আরো ব্যাপকভাবে এগিয়ে আসবেন এই আশা করি। -ফাতেমাতুজ জোহরা

ক্যালিগ্রাফির নন্দনতত্ত্ব : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ


শিল্পকলার গুরুত্ত্বপূর্ণ একটি আভ্যন্তরীণ বিষয় হচ্ছে নন্দনতত্ত্ব। সহজ কথায় নন্দনতত্ত্ব হচ্ছে সৌন্দর্য বিষয়ক মত বা দর্শন। ক্যালিগ্রাফি যেহেতু শিল্পকলার প্রাচীন ও প্রধানতম অংশ। তাই ক্যালিগ্রাফির নন্দনতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে হলে কয়েকটি বিষয় খোলাসা হওয়া প্রযোজন। বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফির নন্দন বিষংক আলোচনায় এ অঞ্চলের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির বিশ্বাস, আচরণ, সৌন্দর্যপ্রিয়তা, মূল্যবোধ প্রভৃতি বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। ক্যালিগ্রাফির নন্দনতত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় আসলে আরবি ক্যালিগ্রাফির যে চর্চা সাম্প্রতিক বাংলাদেশে চলছে এর সাথে বাংলা ক্যালিগ্রাফি ও কিঞ্চিৎ অন্যান্য ভাষাবর্ণের ব্যবহার আমরা এখানে লক্ষ্য করে থাকি, তারই উলে¬লখের প্রয়াস থাকবে। ক্যালিগ্রাফি চর্চা এদেশে এখন বেশ জোরেশোরে চলছে। প্রতি বছর একক কিংবা দলগত প্রদর্শনী হচ্ছে, ক্যালিগ্রাফির সংগঠনও দু’চারটি হয়েছে তাদের কার্যক্রম চলছে, ক্যালিগ্রাফির শৈলী ও পেইন্টিং বিষয়ে এখন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। সেমিনার, ওয়ার্কশপ প্রভৃতির নিংমিত আয়োজন আমরা প্রত্যক্ষ করছি। এতে খুব দ্রুত আমাদের সামনে চলমান ক্যালিগ্রাফির আঙ্গিকগত, সরসরগত ও সৌন্দর্যবিষয়ক ধারণার পরিবর্তন হচ্ছে। বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি প্রধানত আরবি হরফনির্ভর। দর্শক ও ক্যালিগ্রাফির শিল্পকর্ম সংগ্রহকারীদের আগ্রহের দিক বিবেচনায় শিল্পী ও ক্যালিগ্রাফারগণও সেরকম শিল্পকর্ম তৈরী করে থাকেন বলে ধারণা হয়। আরবি হরফনির্ভর ক্যাফিগ্রাফিও এদেশের দু'টো ধারায় চর্চা হচ্ছে, শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফি এবং পেইন্টিং নির্ভর ক্যালিগ্রাফি। শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির নন্দতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এদেশের প্রচলিত আরবি হরফ সম্পর্কে সাধারণের মাঝে যে ধারণা রয়েছে সেটা বিবেচনা করা প্রয়োজন। এদেশের জনগোষ্ঠির বৃহত্তম অংশ আরবি হরফ বলতে কোলকাতা ছাপার কুরআনের হরফ বুঝে থাকেন। এই হরফ মূলত: নিশ্চল বা গতিহীন টাইপ সেট। এতে হাতের লেখার জীবন্তপ্রবাহ খুঁজে পাওয়া যায় না। যদিও খুব সীমিত পরিসরে লৌখনু ছাপার কুরআন রয়েছে, তবু তা অধিকাংশের কাছে পাঠ করা কঠিন বলে অনুযোগ রয়েছে। সুতরাং শৈলী বিষয়ক নন্দনতত্ত্বের আলোচনায় এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আরবি ক্যালিগ্রাফিতে শৈলীগত বিশুদ্ধতা যেটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, তার চর্চা আরব দেশগুলোতে বিদ্যমান রয়েছে। বিশেষ করে তুরস্কে আরবি হরফ তাদের ভাষায় এখন ব্যবহার না করলেও ক্যালিগ্রাফিতে এখন পর্যন্ত শৈলীগত বিশুদ্ধতায় তারা শ্রেষ্ঠ। সুলুস বা এক তৃতীয়াংশ, দিওয়ানী বা প্রশাসনিক, নাশখ বা কফি করা প্রভৃতি নামের শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফি চর্চায় তুরস্কের ক্যালিগ্রাফাররা প্রথম সারির ভূমিকা রেখে চলেছেন। সুতরাং তুরষ্কের শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির নন্দনরূপ আর বাংলাদেশের শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির সৌন্দর্যরূপ এক পর্যায়ের নয়। বাংলদেশের ক্যালিগ্রাফারগণ (হাতেগোণা কয়েকজন) শৈলীভিত্তিক যে ক্যালিগ্রাফি করে থাকেন, তা এ দেশের জনগোষ্ঠির দর্শনগত ও আরবি হরফের সাথে পরিচয়পূর্ব দিক বিবেচনায় সৌন্দর্যরূপ স্থানীয় মানের সাথে সামঞ্জস্যশীল। যদিও ইরানী নাস্তালিক শৈলীর ব্যবহার এখানে সাম্প্রতিক যা হচ্ছে। মাত্র ২শ বছর পূর্বেও তার থেকে বহু উঁচু মানের কাজ আমরা প্রাচীন শিলা লিপিতে দেখতে পাই। এমনকি সুলতানী আমলের বেঙ্গল তুগরা, সুলস, নাশখ প্রভৃতি শৈলীরও ব্যবহার এখন পূর্বের মান অতিক্রম করতে পারেনি। এখানে সাম্প্রতিক হাতে লেখা হয়েছে কয়েকটি কুরআনশরীফ যেমন-মেহেদি পাতার কুরআন, ইসালমিক ফাউন্ডেশনের লাইব্রেরিতে রক্ষিত কুরআন, এমন কি ১৯৭৭ সালে জাদুঘরের ইসলামিক প্রতœ প্রদর্শনীতে দেয়া এক মহিলা শিল্পীর হাতে লেখা কুরআন শরীফটির শৈলীগত মান আশাবঞ্জক নয়। এটা সম্ভবত এজন্য হয়েছে কারণ কোলকাতা ছাপার হরফ তাদের কাছে সৌন্দর্য রূপ হিসেবে প্রতিয়মান হয়েছে কিংবা তারা মৌলিক আরবি শৈলীর সাথে পরিচিত হতে পারেনি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের সহজ লভ্যতা, ইন্টারনেট, আরবি পত্র-পত্রিকা, এমনকি ডিশলাইনের আরবি চ্যানেলগুলোয় আরবি হরফের মনকাড়া অঙ্গসৌষ্ঠব দেখে আমাদের কাছে আরবি ক্যালিগ্রাফির স্বরূপ বিশেষ করে শৈলীগত বিশুদ্ধ সৌন্দর্যরূপ উন্মোচিত হতে চলেছে। সাম্প্রতিক পর্যায়ক্রমিক কয়েকটি ক্যালিগ্রাফির প্রদর্শনী পর্যালোচনা করলে শৈলীগত সৌন্দর্যরূপের এই পরিবর্তন চোখে পড়ে। এক দশক পূর্বে এদেশের ক্যালেন্ডারসমূহ ঘেটে দেখলে ক্যালিগ্রাফিবিহীন একটি দৃশ্য আমরা দেখতে পাই। কিন্তু এখন বহু প্রতিষ্ঠানের ক্যালেন্ডারে নিয়মিতভাবে ক্যালিগ্রাফি স্থান দখল করে চলছে। এসব ক্যালেন্ডারের ক্যালিগ্রাফিতে শৈলীবিষয়ক পরিবর্তন চোখে পড়ার মত। নন্দনতত্ত্বের এই যে স্বরূপ আমরা দেখছি সেটা দিন বদলের সাথেসাথে পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু ক্যালিগ্রাফির শৈলীভিত্তিক নন্দনতত্ত্ব বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে কী হওয়া উচিত সে আলোচনার চেয়ে পরিবর্তনের স্বরূপ আলোচনাটা বেশি ফলদায়ক। শৈলীর বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য উচ্চকিত এ দেশের শীর্ষ স্থানীয় একজন ক্যালিগ্রাফি শিল্পীর কাজে ‘ক্যালিগ্রাফি কলম’ অর্থাৎ খাগ বা বাঁশের কলমের সরাসরি প্রয়োগ এখনও আমরা দেখতে পাইনি। কিন্তু বাস্তব কথা হলো শৈলীর নন্দনতাত্ত্বিক পরিবর্তন বিশেষ করে ইমপ্র“ভমেন্ট বা উচ্চমানে আরেহণের জন্য ক্যালিগ্রাফি কলমের ব্যবহার অপরিহার্য। একথা এজন্য বলা হলো, যদি আমরা শৈলীর বিশুদ্ধতা কিংবা ইমপ্র“ভমেন্ট আক্ষরিক অর্থে সেভাবেই চাইতাম তাহলে নন্দনতাত্ত্বিক স্বরূপও আমরা সেরকম দেখতে পেতাম। আরবি ক্যালিগ্রাফির শৈলীভিত্তিক নন্দনতাত্ত্বিক বিষয়ে একটি কথা না বললেই নয়। প্রতি তিন বছর পর পর তরস্কে ওআইসির গবেষণা বিভাগ আন্তর্জাতিক শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। ২০০৬-০৭ সালে ৭ম হাশিম মুহাম্মদ বাগদাদী স্মরণে ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এতে লাখ লাখ টাকার পুরস্কার দেয়া হয় শুধু কাগজের ওপর কালো কালিতে ক্যালিগ্রাফির জন্য। প্রতিযোগিতার আয়োজকদের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির বিশুদ্ধতা রক্ষা ও এর নন্দন তাত্ত্বিক স্বরূপকে পশ্চিমা ক্যালিগ্রাফি কিংবা বিদেশী প্রভাব থেকে রক্ষা করে ইমপ্র“ভমেন্ট বজায় রাখা । অবস্য এর সাথে আধ্যাত্মিক স্পিরিটও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তাহলে আরবি ক্যালিগ্রাফির শৈলী ভিত্তিক নন্দন তাত্ত্বিক স্বরূপ বা দর্শন কি? কয়েকটি বিষয় এর সাথে জড়িত, হরফের সঠিক সেপ ও সাইজ যেটা আল খাত আল মানসুব বা আনুপাতিক লেখনীর সাথে সম্পৃক্ত এবং ইবনে বাওয়াবের মানসুব আল ফায়েক অর্থাৎ সৌন্দর্যময় লেখনী আক্ষরিক অর্থে আরবি ক্যালিগ্রাফির শৈলীভিত্তিক নন্দনতত্ত্বের সাথে সংশি¬লষ্ট। এছাড়া ইয়াকুত আল মুস্তাসিমীর কলম কাটার কলাকৌশল এতে পূর্ণতা এনেছে। কালির প্রস্তুতবিধি, ব্যবহার নীতিমালা, কাগজ বা উপায়-উপকরণ এটি নির্দিষ্ট বিধিমালার অন্তর্ভুক্ত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সুলুস লিপির আলিফটি ক্যালিগ্রাফি কলম দিয়ে লিখতে তিনটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। র’স বা মাথা হবে দেড় থেকে দুই ফোটা বা নোকতা বরাবর এবং হেসম বা শরীরটি ৫-৬ নোকতা বরাবর লম্বা হবে। শেষে মাথার নীচে আকশিটি কলমের ডান কোণা দিয়ে পূরণ করতে হয়। এটা হল সাধারণ নিয়ম কিন্তু হরফের আকৃতি ও পরিমাপ ঠিক রাখর সাথে সাথে এর রৈখিক বাক ও ভাজগুলোও যথাযথ করতে হয়। এটি সরাসরি নন্দনতত্ত্বের সাথে সংশি¬লষ্ট যেটা হাতেকলমে ওস্তাদ ছাত্রকে শিখিয়ে থাকেন, দর্শককেও এ বিষয়ে হাতে কলমে আত্মস্থ করতে হয়। বাংলদেশে ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে ইদানীং বেশ লেখা লেখি হচ্ছে, অনেকে আগ্রহ নিয়ে লিখছেন, কিন্তু ক্যালিগ্রাফির সত্যিকার উন্নয়নে যথার্থ আলোচনা আসছে না। বিষয়টির প্রতি ভালেবাসা ও আত্মিক অনুভব নিয়ে হয়ত তারা লিখছেন, যেমন- একটি জাতীয় দৈনিকে ক্যালিগ্রাফির নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে একজন এমফিল গবেষকের একটি লেখা ছাপা হয়েছে। আমার জানামতে, ১৯৭৯ সালে ড. পারেস ইসলাম ক্যালিগ্রাফির ওপর পিএইচডি ডিগ্রি লাভের পর ২০০৬ সালে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুহাম্মদ নূরুর রহমান এ বিষয়ে এমফিল ডিগ্রি লাভ করেছেন। তার অভিসন্দর্ভটির বিষয় ছিল “আরবি ক্যালিগ্রাফির উদ্ভব ও বিকাশঃ পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ।” এছাড়া আল কুরআনের ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে অন্য একজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল করছেন। কিন্তু ক্যালিগ্রাফির নন্দনতত্ত্বের মত স্পর্শকাতর ও সূক্ষ্ম টেকনিক্যাল বিষয়ে রচিত ভিন্ন বিষয়ে এমফিল গবেষকের লেখাটি যথার্থ আলোচনার দাবি পূরণ করেনি। লেখাটি মূলত ইতিহাস ও ক্রমধারার ওপর একটি গতানুগতিক রচনা। বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি সম্পর্কেও দায়সারা আলেচনা হয়েছে সেখানে এবং কিছুটা ফরমায়েসি ধরনের লেখা বলেও ধারণা হয়। তার লেখা ইতোপূর্বে দু’একবার ছাপা হয়েছে এবং সেগুলো একই রকমের। রচনাটি হযরত আলী (রাঃ) এর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু হয়েছে কিন্তু উদ্ধৃতিটি মূলতঃ রাসূলে আকরাম সাল¬লাললাহু আলাইহে ওয়াসাললামের। মুসনাদে ফেরদৌস, দায়লামী শরীফে হাদীসটির উল্লেখ রয়েছে (সূত্র ঃ কামেল সালমান আল জাবুরী, মুসেআহ আল খত আল আরাবি, পৃষ্ঠা-২০)। যাহোক আরবি ক্যালিগ্রাফি যাকে আল খত আল আরাবি বলা হয়। বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের দেশে যে উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে তাতে এ বিষয়ে যথার্থ আলোচনা ও চর্চায় সংশি¬লষ্টরা আরো আন্তরিক ও সক্রিয় হবেন এই আশা করা যায়।-মোহাম্মদ আব্দুর রহীম

আরবী ক্যালিগ্রাফির প্রকার ও প্রকরণ


ক্যালিগ্রাফি সম্পর্কে আমরা মোটামুটি একটি ধারণা পেয়েছি। সুন্দর ও শিল্পসম্মত হস্তলিপিকে আমরা ক্যালিগ্রাফি বলি। আরবী ক্যালিগ্রাফি এখন বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন প্রদর্শনী, ক্যালেন্ডার, বইয়ের প্রচ্ছদ প্রভৃতিতে আরবী ক্যালিগ্রাফির বহুল ব্যবহার লক্ষণীয়। বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়ে বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফিকে আমর দু’ভাগে বিভক্ত করতে পারি। ১. ট্রেডিশনাল বা দ্রুপদি ধারা ২. পেইন্টিং ক্যালিগ্রাফি। ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফি হচ্ছে আরবী ক্যালিগ্রাফির শৈলীগত নীতিমালা অনুসরণ করে নিখুঁত হরফের নতুন নতুন কম্পোজিশনের ক্যালিগ্রাফি রচনা করা। শৈলীগত আলোচনায় নির্দিষ্ট ফন্টের কথা এসে যায়। দ্রুপদি ধারায় স্থান বা ভৌগোলিক দিক দিয়ে কিছু ফন্টের নামকরণ হয়েছে যেমন- কুফি। ইরাকের একটি নগরী কুফার নামানুসারে এই নামকরণ হয়েছে। এছাড়া মক্কী, মাদানী, বিহারী প্রভৃতি লিপির নাম আমরা পেয়ে থাকি। শৈলীর আক্ষরিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় যে লিপিগুলো এসেছে তা হচ্ছে সুলুস অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশ, মুহাক্বাক, আর্থাৎ অধিকতর বিশেল¬ষিত, মাইল অর্থাৎ ঝোঁক প্রবণ ইত্যাদি। রাজকীয পৃষ্ঠপোষকতার জন্য যেমন রিয়াসী অর্থাৎ সরকারি দিওয়ানী অর্থাৎ প্রশাসনিক। এমনকি ব্যক্তি নামেও লিপির নামকরণ হয়েছে যেমন- রায়হানী। আলী ইবনে উবাইদাহ আ রায়হানী (মৃত্যু-৮৩৪ খৃ:) এই লিপির আবিষ্কার। আকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের জন্যও নামকরণ হয়েছে যেমন- গুবার লিপি ক্ষুদ্র বালুকণার মত আকৃতির জন্য লিপিটিকে গুবার বলা হলেও আসলে লিপিটি হচ্ছে নাসখী সগীর বা ছোট নাসখ। ঝুলন্ত স্বভাবের রেখার জন্য তালিক এবং অতিমাত্রায় ঝুলন্ত ও বক্র স্বভাবের জন্য শিকাস্তে নাস্তালিক নামকরণ হয়েছে। ট্রেডিশনাল ধারায় আরোবহু প্রকার লিপি রয়েছে। আধুনিক কালে ক্যালিগ্রাফিকে পেইন্টিংয়ে উপস্থাপন করা হচ্ছে। একে ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং হিসেবে আমরা আখ্যায়িত করছি। পেইন্টিং বা চিত্রকলার নিয়মনীতি মেনে ক্যালিগ্রাফিকে অনুষঙ্গ করে যে ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম নির্মিত হচ্ছে তাকে ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং বলা হয়। বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং-এর শিল্পকর্মই বেশি নিমিটত হচ্ছে। ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিংয়ে আবার দুই ধরনের চরিত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ১. শৈলী নির্ভর ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং ২. শুধু হরফের অবয়বকে ব্যবহার করে বা অনুষঙ্গ ধরে পেইন্টিং নির্মাণ। শৈলী নির্ভর ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিংয়ে ট্রেডিশনাল ধারার বৈশিষ্ট্যকে আক্ষুণœ রেখে পেইন্টিং করা হয়। অন্যদিকে আধা বিমূর্ত বা বিমূর্ত পদ্ধতি অনুসরণ করে হরফের আদল দিয়ে পেইন্টিং নির্মাণ করা। এতে পেইন্টিংটিকে দেখে একটি ভাব হৃদয়ে জেগে উঠলেও বাস্তবে সেটা আমার প্রকাশ করতে পারি না।-মোহাম্মদ আবদুর রহীম

আধ্যাত্মিক শিল্প ক্যালিগ্রাফি


শিল্পকলার জগতে ক্যালিগ্রাফি একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ইসলামে আরবি ক্যালিগ্রাফিও পৌছে গেছে দেশে দেশে। এই শিল্পটি যেমন সত্য সুন্দরের বাহন, তেমনি আত্মার খোরাক। আব্বাসীয় আমল (৭৫১-১২৫৮) থেকে আরবি ক্যলিগ্রাফি শৈল্পিক র বাণী পৌছানোর সাথে সাথেআধ্যাত্মিক বিকাশ ঘটতে শুরু করে। প্রয়োজনীয় উপকরণ ও যন্ত্রপাতির মাধ্যমে আধ্যাতিক রেখা অঙ্ককে আরবি ক্যালিগ্রাফি বলে। ইংরেজীতে একে বলে ¯িপরিচুয়াল জিওমেট্রি। তুর্কী ভাষায় যাকে রুহী হান্দেজ বলা হয়ে থাকে। নন্দন তাত্ত্বিক এই সংজ্ঞা কালের বিচারে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত। হরফের পর হরফ বসিয়ে এবং হরফের নানান রূপের ব্যবহারে একটি ক্যালিগ্রাফি সার্থকভাবে আধ্যাত্মিক ভাব প্রকাশ করে।আরবি হরফের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে কোন হরফ শব্দের প্রথমে মধ্যে ও শেষে ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়। শৈল্পিক বিচারে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই শব্দ বিভিন্নভাবে লেখা যায়। আকৃতিগত ভিন্নতার জন্য একই শব্দে সৃজনশীলতার যোগ ঘটিয়ে কম্পোজিশনে বিভিন্নতা আনায়ন করা হয়। যা হয়ে ওঠে শৈল্পিক সৌন্দর্যমন্ডিত। ইসলামী ক্যালিগ্রাফি হিসেবে এখন আরবি ক্যালিগ্রাফিকেই বুঝানো হয়। আরবি ক্যালিগ্রাফি প্রয়োগ সুবিধা, নান্দনিক মান বা এসথেটিক ভেলু এবং আলল¬হর বাণী কুরআনের বাহন হওয়ায় এটা বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। আমরা জানি গবেষকগণ বলেন, নাবাতীয় হরফ থেকে আরবী হরফের উৎপত্তি কিংবা আম্বর, হিরা অঞ্চলের বিশেষ প্রভাব অথবা ফিনিশিয় হরফর গোত্রভুক্ত আরবী হরফ পবিত্র কুরআনের লিপি হওয়ায় এটি বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। ধীরে ধীরে মাক্বী-মাদানী, লিপি হিসেবে কুফী লিপির গোলায়িত ও ঋজু ধারায কুরআনের অসংখ্য অনুলিপি তৈরি হয়। এভাবে বড় মাপের নীবের থেকে বিভিন্ন মাপের কলম তৈরি হয়। ফলে নিসফ বা অর্ধেক, সুলুস বা একর্ তীয়াংশ যাকে কালিমুন নিসফ অর্থাৎ অর্ধেক কলম, হাফিফুন নিসফ বা এক তৃতীয়াংশ, হাফিফুন সুলুস বা দুই তৃতীয়াংশ মাপের কলম দিয়ে লেখা হয়। স্টাইলের নামকরলও হয় তদানুযায়ী। নির্দিষ্ট মাপের কলম দিয়ে নির্দিষ্ট মাপের কাগেেজ লেখা বাধ্যতামূলক করা হয় বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য। উমাইয়া আমলেই (৬৬১-৭৫০) এই উন্নয়ন সাধিত হয়। এরপর আব্বাসীয় আমলে ক্যালিগ্রাফি আর্টিস্টিক ধারায় প্রবাহিত হতে শুরু করে। এ সময় শুরু হয় পবিত্র কুরআনের কপি অলংকরণ। এতে তুর্কি ক্যালিগ্রাফাররা রেখে যান একটি বড় ভূমিকা। এর ভেতর মুহাক্কাক লিপি যেটি ইরাকী নামেও পরিচিত ছিল ইবনে মুকলার আনুপাতিক লেখনীর মাধ্যমে এই উন্নয়ন স্বর্ণশিখরে আরোহন করে। ইসলামী ক্যালিগ্রাফির সাথে আরো যেসব বিষয় সংশি¬লস্ট, তা হচ্ছে যুখরুফাহ আল আরাবিয়া বা অলংকরণ, স্বর্ণমন্ডিত বা গি¬ল্ডিং, কাগজের বর্ডার ডিজাইন, কাগজ মারবেলিং, মিনিয়েচার পেইন্টিয়ের এ্যবস্ট্রাক্ট অংশ। আরবি ক্যালিগ্রাফির আধ্যাতিক দিক বিবেচনায় এ শিল্পের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত শিল্পীদের কর্মকান্ড বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। আব্বাসীয় আমলের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার ইয়াকুত আল মুস্তসিমী নানান কর্মকান্ড ও শিল্পকর্ম তৈরীর পাশাপাশি পবিত্র কুরআনের এক হাজার অনুলিপি তৈরী করেছেন। বিষয় প্রকৃতপক্ষেই অত্যন্ত আশ্চর্য্যরে। কারণ শতখানেক কুরআনের অনুলিপি করেছেন এমন ক্যালিগ্রাফার যেখানে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সেখানে এক হাজার কপি লেখা আসলে অলৌকিক ব্যাপার। ক্যালিগ্রাফির আধ্যাত্মিকতা সমাজের নিম্ন উচ্চ সবারই ওপর প্রবল প্রভাব ফেলেছে। সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদ আমলের একটি ঘটনা। সে সময়ের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার শেখ হামদুল¬লাহকে সুলতান অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন। এতে সমসাময়িক জ্ঞানীগুণী, গবেষকগণ হামদুল¬লাহকেও ঈর্ষা করতে শুরু করেন। একথ জানতে পেরে সুলতান সে সময়ের সকল গবেষক, স্কলার, বুদ্ধিজীবীকে তার প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানান। শেখ হামদুললাহকেও আসতে অনুরোধ করেন। সবাই প্রাসাদে উপস্থিত হলে ড্রত্যেকের কাছ থেকে তাদের লিখিত গ্রন্থ নিয়ে দরবারের মধ্যখানে স্তুপ করেন। এরপর হামদুললাহর হাত থেকে তার হস্তলিখিত কুরআন কপিটি নিয়ে উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এই কুরআন কপিটি কি এই স্তুপের শীর্ষে স্থাপন করবো নাকি ভিতরে ঢুকিয়ে দেবো। তখন সবাই কুরআনের কপিটি গ্রন্থরাজির স্তুপের শীর্ষে স্থাপনের পক্ষে মত প্রদান করেন। তখন সুলতান ঐ গ্রন্থরাজির লেখকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, এই গ্রন্থ যেমন সম্মানিত ও মর্যাদাবান, এর লিপিকারও তেমনি সম্মানিত ও উচ্চাসনের অধিকারী, সুতরাং আমি আশা করবো আপনাদের কারো কাছ থেকে যেন এর লিপিকারের প্রতি সামান্যতম অসম্মানের কোন কিছু প্রকাশ না পায়। ক্যালিগ্রাফির আধ্যাত্মিকতা দর্শকদেও যেমন প্রভাবিত করে তেমনি স্বয়ং ক্যালিগ্রাফি শিল্পীই এর আধ্যাত্মিকতা মর্মে মর্মে অনুভব করে থাকেন। ক্যালিগ্রাফি শিল্প কর্ম করতে প্রত্যেক শিল্পী নিজেকে পবিত্র রাখেন এবং স্রষ্টার একান্ত সাহায্য ও আনুকুল্য কামনা করেন। এতে করে শিল্পকর্মের ভেতর উপস্থাপিত হরফের রেখাগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে এবং স্রষ্টার সাথে মৌন আলাপনের ভাব হৃদয়ে জেগে ওঠে। বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্প সেই আধ্যাত্মিক পথেই ধাবিত হচ্ছে। ট্রেডিশনাল ধারা কিংবা পেইন্টিংয়ে উপস্থাপিত ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম আমাদের আন্দোলিত করে আর নির্মল রসে সিক্ত করে। গত একদশক ধরে বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্প বিশেষ করে ঢাকা সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র ক্যালিগ্রাফি সোসাইটির যৌথ আয়োজনে প্রতি বছর সীরাতুন্নবী (সঃ) উপলক্ষে রবিউল আউয়াল মাসে অনুষ্ঠিত ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী একটি বিশাল আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছে। এই প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্মের আধ্যাত্মিক প্রভাব আমরা সমাজের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে লক্ষ্য করছি। প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ক্যালেন্ডারে ব্যাপকভাবে ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার হচ্ছে। সত্য ও সুন্দরের চর্চায় ক্যালিগ্রাফির আধ্যাত্মিক প্রভাব তাই অনস্বীকার্য। বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি একটি মহৎ শিল্পধারা হিসেবে সফলভাবে এগিয়ে চলতে সংশি¬লষ্ট সকলের আরো সক্রিয় ও আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করছি।-মোহাম্মদ আবদুর রহীম

বিশ্বাসী মায়েদের হাতের ক্যালিগ্রাফি কুরআন


সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিম বিশ্বে ইসলামী বিশ্বাস নবতর উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলেছে, এসময়ের আধুনিক মুসলিম সমাজ ক্রমাগত ইসলমের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। মালয়েশিয়ায় এ রকম একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগের বিষয় সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। মাসহাফ নূর ফাতেমা এমনই একটি নজরকাড়া প্রজেক্টের নাম। মালয়েশিয়ার ইয়াইয়াসান রেস্টো (আল বারাকা ফাউন্ডেশন) এই যুগান্তকরী প্রজেক্টটি চালু করেছে। এই প্রজেক্টের উদ্দেশ্য হচ্ছে শুধুমাত্র মহিলা ক্যালিগ্রাফার, কাতিব ও অলংকরন শিল্পী দিয়ে ওসমানীয় লিপী বা নশখী লিপিতে পবিত্র কুরআনের কপি তৈরী করে ছাপানোর ব্যবস্থা করা। যদিও চুড়ান্তভাবে কুরআনের এই প্রজেক্টটির নামকরণ হয়নি। তবু হয়তো একে“বিশ্বাসী মহিলাদের কুরআন” কিংবা “বিশ্বাসী মায়েদের কুরআন” নাম দেয়া হতে পারে। প্রজেক্টটিতে শুধুমাত্র মহিলা ক্যালিগ্রাফার, শিল্পী ও মহিলা হাফিজাহ অর্থাৎ পবিত্র কুরআনের মহিলা হাফেজ, নিরীক্ষক এবং সংশ্লি¬ষ্ট সবাই মহিলা। ইসলামের ইতিহাসেও দেখা গেছে স্পেনের আন্দালুসিয়ায় ৮শ বছর ধরে মুসলমানরা শাসন করেছে। সেখানে প্রায় ২০ হাজার মহিলা ক্যালিগ্রাফার ও কুরআনের লিপিকার ছিল। এদের মধ্যে অনেকে অবশ্য পুরো কুরআন লিপিবদ্ধ করেননি। কর্মকর্তদের মতে, পরিপূর্ণ ভাবে প্রজেক্টের প্রতিটি ক্ষেত্রে মহিলা কর্মি নিয়োগের বিষয় হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই প্রথম উদ্যোগ। বিশেষ করে কুরআন অলংকরণ, স্বর্ণমন্ডনের মত সূহ্ম ও ধৈর্যশীল কাজে মহিলাদের অংশ গ্রহণ একটি উলেল¬খযোগ্য বিষয়। কুরআন প্রজেক্টের কাজের পরিকল্পনার অশং হিসেবে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্ত থেকে ড্রইং ও অলংকরণ সংগ্রহ করা হচ্ছে, যাতে মালয়েশিয়ায় এই প্রজেক্টের প্রথম মাসহাফ বা হাতে লেখা কুরআন কপিটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়। এজন্য যাবতীয় তথ্য সংগ্রহের জন্য পৃথিবীর ম্যাপকে ৮ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আরব বিশ্ব, তুরষ্ক, পাকিস্তান ও ইরান, সাবসারান আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া (প্রধানত ইন্ডিয়া), দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরের উপকুলবর্তী দেশসমূহ ও দুই আমেরিকা। প্রতিটি অঞ্চল বিষেশে গবেষণ করে দেখা গেছে যে, প্রত্যেকটি অঞ্চলের ডিজাইন ও ড্রইং নিজস্ব স্বকীয়তা প্রকাশ করেছে। তবে কিছু সাধারণ স্থাপত্য নকশা ও অলংকরণ সব অঞ্চলেই একই রাখা হয়েছে। ঠিক তেমনিভাবে লতাপাতা ও ফুল নিয়ে গবেষণা করে দেখা গেছে প্রত্যেক অঞ্চলেই কিছু স্থানীয় রোগ-ব্যাধি রয়েছে এবং সেগুলোর প্রতিষেধক হিসেবে স্থানীয় লতাগুল্মফুল ব্যবহার করা হয়। ফাউন্ডেশন অনুরূপ একটি তুলনামুলক গবেষণায় দেখেছে যে, এই রোগের জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে ভিন্ন ভিন্ন লতাগুল্মের ব্যবহার হয়ে থাকে। এতকাল মালয়েশিয়ায় মাসহাফ শরীফের অনুলিপি ও অলংকরণে পুরুষ ক্যলিগ্রাফার ডিজাইনারগণ নিয়োজিত ছিলেন। তাদের তৈরী মাসহাফের বহিফ্রেমটিতে ঢেউয়ের মত অলংকরণ বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। পৃষ্ঠার উপর-নীচের সেকশনেও ভিন্ন ভিন্ন অলংকরণ ব্যবহৃত হয়েছে। মালয়েশিয়ায় অধিকাংশ মাসহাফ শরীফের পৃষ্ঠার পাশে হাদীস ও ব্যাখ্যা ইংরেজী ও মালয় ভাষায় দেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রমী এই কুরআনটিতে শুধুমাত্র মহিলা বিষয়ক আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যা মালয় ভাষায় পৃষ্ঠার পাশে দেয়া হয়েছে। সাবেক রাণী সিতি আয়েশা স্বামী সুলতান সালাউদ্দিন আবদুল আযীয শাহ ইন্তেকালের (২০০২) পূর্ব পর্যন্ত গভীর আগ্রহ নিয়ে এই প্রজেক্টে পৃষ্ঠপোষকতা চালিয়ে যান। তারই অনুপ্রেরণায় ২০০৫সালে এই প্রজেক্ট পূর্ণতা পায়। ২০০০ সালে তেহরানের আন্তর্জাতিক কুরআন প্রদর্শনীতে ফাউন্ডেশন ‘জুঝ আম্মা’ অর্থাৎ ৩০ তম পারার খন্ডটি নিয়ে অংশ গ্রহণ করে। ফাউন্ডেশনের অসাধারণ কর্মোদ্দীপনার জন্য ইরানী প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ খাতামী শ্রেষ্ঠ প্রজেক্টের পুরস্কার প্রদান করেন তাদের। প্রজেক্টের জুঝ আম্মাটি একটি মাস্টারপিস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এছাড়া প্রজেক্টের কর্মপরিষদ সূরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসী, সুরা ইয়াসিন, সুরা আল সাজদাহর আহকাম আত তাজবিদ (পঠন নীতিমালা) সহ ইংরেজি তরজমাও প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। মালয়েশিয়ার এই কুরআন প্রজেক্টের কুরআনের পৃষ্ঠার চারপাশের মার্জিনে ব্যতিক্রমী ধরনের ডিজাইন করা হয়েছে। প্যাটার্ন ডিজাইনে এমন সব মটিফ ব্যবহার করা হয়েছে যেটি পাঠকের হৃদয়ে আলাদা ধরনের প্রভাব ফেলবে এবং সচেতনতার সৃষ্টি করবে, যেমন সুরা আল ফাতিহার চারপাশের বর্ডারে নারকেল গাঝকে মটিফ আকারে প্যাটার্ন করে বসানো হয়েছে। এতে আরবে যেমন খেজুর ফলটি আরববাসীর জীবনযাত্রায় বিশাল প্রভাব ফেলে, তেমনি দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় নারকেলও খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ অঞ্চলের মানুষের জীবনে নারকেল যেমন বিশাল আংশ জুড়ে রয়েছে সুরা ফাতিহাও তেমনি মানব জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও নিরাময়ের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অনুসঙ্গ। এই ম্যাসেজ ও অনুভূতি যাতে পাঠকের হৃদয়ে জেগে ওঠে, সে জন্য এই ধরনের ডিজাইন এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। অনুরূপ ৩০তম পারার বর্ডারে ম্যাঙ্গোস্টিন ফলের ড্রইং দেয়া হয়েছে। এই ফলটিও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে জন্মে থাকে। ফলটির বহির্ত্বক দেখতে ততটা দৃষ্টি নন্দন না হলেও এর খোশার ভেতর ফলটুকু অত্যন্ত সুস্বাদু, মিষ্টি এবং লোভনীয়, ঠিক তেমনিভাবে কেউ কুরআন অধ্যয়নের সাথে সাথে শুধু এর মজাটুকুই পাবেনা বরং ধীরে ধীরে সে এর আধ্যাত্মিক বিষয়ও উপলব্ধি করতে থাকবে। সুরা ইয়াসীনের বর্ডারে তামারিন্দ বা তামার আল হিন্দ অর্থৎ ইন্ডিয়ার খেজুর তেঁতুল গাছের মটিফ ব্যবহার করা হয়েছে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মুসলমানরা বৃহস্পতিবার রাতে এ সুরাটি অধিক একাগ্রতা ও আগ্রহের সাথে তেলাওয়াত করে থাকে। তেতুল যেমন শরীরকে শীতল ও স্নিগ্ধ করে তেমনি সুরা ইয়াসিনও আত্মার প্রশান্তি বয়ে আনে। সুরা সাজদার বর্ডার ডিজাইন করা হয়েছে ধানের মটিফ ব্যবহার করে। ধান মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামের প্রধান খাদ্য ফসল। এ অঞ্চলের জীবন যাত্রা, সংস্কৃতি, কাব্য, প্রবাদ প্রবচনে ধান বিশাল প্রভাব বিস্তার করে আছে। ধানকে এজন্য বাছাই করা হয়েছে যখন ধান পাকে তখন শস্যদানার ভারে শীষ অবনত হয়ে যায়। যেন সে আল¬াহর উদ্দেশ্যে সিজদাবনত। এছাড়া ধান পাকার আগে এর সবুজ আভা হৃদয়কে সিক্ত করে। আয়াতুল কুরসীর বর্ডার ডিজাইন করা হয়েছে লেবু গাছের মটিফ ব্যবহার করে। করণ, লেবু শরীরকে নীরোগ রাখতে বিশেষ ভুমিকা রেখে থাকে। তেমনিভাবে আয়াতুল কুরসী মানব জীবনকে কবালা মুসিবত থেকে হেফাজতে রাখে। পবিত্র কুরআনের এসথেটিক দিকটি যেমন মুসলিম ক্যালিগ্রাফারদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তেমনি আলল¬াহর কালাম হিসেবে এর অলৌকিক প্রভাব মুসলিম সমাজে গভীরভাবে রেখাপাত করে থাকে, সেটা মায়েদের কুরআন ক্যালিগ্রাফি করার এই মালয়েশীয় প্রয়াস থেকে আবারও প্রমাণিত হল। বাংলাদেশে ধীরেধীরে মহিলা ক্যালিগ্রাফার গড়ে উঠছেন তাও আমরা গত একদশক থেকে বিভন্ন কালিগ্রাফি প্রদর্শনীতে উলে¬লখযোগ্য হারে মেয়েদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে জানতে পেরেছি।

বাংলাদেশে যদিও শৈলী বা বিভিন্ন ট্রেডিশনাল ফ্রন্টে মহিলা ক্যালিগ্রাফার পাওয়া কঠিন, তবু ক্যালিগ্রাফি সোসাইটির উদ্যোগে বেশ কয়েকজন মহিলা ইতোমধ্যে ক্যালিগ্রাফির তালিম নিচ্ছেন। আশা করা যায়, আর এক দশক পর বাংলাদেশেও প্রফেশনাল মহিলা ক্যালিগ্রাফার পাওয়া যাবে।-মোহাম্মদ আবদুর রহীম

ঐতিহ্যবাহী হোসনী দালানের অভ্যন্তরে ক্যালিগ্রাফি


পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী হোসনী দালানের অভ্যন্তরে সিলিংয়ের চারপাশে ঢালু জায়গায় নতুন করে সংস্কার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ক্যালিগ্রাফি শিল্পীদের সাথে তারা যোগাযোগ করেন এবং উল্লেখিত স্থানে ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফি করার কথা জানান। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ক্যালিগ্রাফি শিল্পী মোহাম্মদ আবদুর রহীমের নমুনা ক্যালিগ্রাফি মনোনীত হয়। সুলুস শৈলীতে পবিত্র কুরআনের সুরা আর-রাহমান চারপাশে ঘুরিয়ে করার সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত হয়। (ছবিতে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ক্যালিগ্রাফি শিল্পী মোহাম্মদ আবদুর রহীমের নমুনা ক্যালিগ্রাফি)