আর্ট অব হেভেন বলতে শিল্পকলার জগতে ইসলামী ক্যালিগ্রাফিকে বুঝানো হয়ে থাকে। গবেষকগণ একে ডেকোরেটিভ আর্ট বা অলঙ্করণ শিল্পকলা নামেও অবিহিত করে থাকেন। সাম্প্রতিককালে ব্যাপক গবেষণা ও আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির উপাত্ত ব্যবহার করে এ বিষয়ের পণ্ডিতগণ মত প্রকাশ করেছেন।
ইসলামী ক্যালিগ্রাফি বলে যে শিল্পকলাকে পাশ্চাত্যের পণ্ডিতগণের আমাদের সামনে ধর্মীয় গণ্ডিবদ্ধ, সীমাবদ্ধ এবং একপেশে হিসেবে তুলে ধরার প্রায়াস লক্ষ্য করা যায়, চলমান গবেষণায় সেটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বরং একে প্রাগ্রসর বিশুদ্ধ শিল্পকলা বলে অভিহিত করেছেন গবেষকগণ। ধর্মীয়ভাবে যেমন ইহুদী-খৃস্টান-বৌদ্ধ এমনকি হিন্দু ধর্মের সাথে সরাসরি সংশি¬ষ্ট শিল্পকলা চর্চাকে উপাসনার অংশ ধরা হয়। কিন্তু ইসলাম ক্যালিগ্রাফি চর্চার মত শিল্পকে ইবাদতের অংশ মনে করে না। ইসলামী শরীয়তে ইবাদতের বিষয় বলে একে গণ্য করা হয় না বরং শুধুমাত্র বিউটি বা সৌন্দর্যের বিষয় হিসেবে একে বিবেচনা করা হয়।
ইসলামী ক্যালিগ্রাফি মূলত আরবী বর্ণমালাকে ভিত্তি করে বিশ্বব্যাপী একচ্ছত্র বিশুদ্ধ শিল্পকলা হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদায় সমাসীন রয়েছে। সুতরাং ইসলামী ক্যালিগ্রাফির আলোচনায় এর উদ্ভব এবং প্রাসঙ্গিক বিষয় অনিবার্যভাবে এসে যায়। প্রসঙ্গক্রমে আরবী হরফের গোড়ার কথা নিয়ে আলোকপাত করতে গেলে আমরা দেখতে পাই যে, এর উৎপত্তি নিয়ে ইতিহাসবিদ ও গবেষকগণের মধ্যে নানাবিধ মতামত রয়েছে কারণ ১০ম শতাব্দীর আব্বাসীয় শাসনামল থেকেই কেবলমাত্র এ সম্পর্কে স্পষ্ট বর্ণনা আমরা গবেষক ও ইতিহাসবিদগণের কাজ থেকে পেয়েছি।
আমরা জানি লিপিকলাকে ইংরেজীকে ক্যালিগ্রাফি বলে। এটি মূলতঃ গ্রীক শব্দ ক্যালিগ্রাফিয়া থেকে উৎসারিত। গ্রীক শব্দ ক্যালোস অর্থ হচ্ছে সুন্দর, চমৎকার আর গ্রাফেইন অর্থ লেখা। এ শব্দ দুটোর মিলিত রূপ থেকেই ক্যালিগ্রাফি এসেছে। শিল্পকলায় একে লিখনশিল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দর্শক যখন একে হৃদয়ের অনুভূতি দিয়ে গ্রহন করে মূলতঃ তখনই এটা শিল্প হিসেবে আমাদের কাছে ধরা দেয়। ইসলামী ক্যালিগ্রাফি বা লাতিন ভাষায় “ক্যালিগ্রাফিয়া ইসলামিকা” হচ্ছে পবিত্র কুরআন-হাদীসের বাণী নির্ভর অনুপম শিল্প। যিনি এটা করেন তাকে আমরা লিপিকার বা কাতিব বলে থাকি। কিন্তু এই অনুলিপির সাথে যখন নান্দনিকতা যুক্ত হয় তখন তা লিপিশিল্পে পরিণত হয়। আরবীতে লিপিশিল্পকে বলা হয়, “আল খত আল আরাবী”। যিনি লিপিশিল্পী তাকে “খাত্তাত” বলে সম্বোধন করা হয়। ঠিক ইংরেজীতে ক্যালিগ্রাফি এবং ক্যালিগ্রাফার বলা হয় যথাক্রমে লিপিশিল্প ও লিপিশিল্পীকে। ফারসী ভাষায় ক্যালিগ্রাফিকে “খোশনবীশী” এবং ক্যালিগ্রাফারকে খোশনবীশ বলা হয়। তেমনিভাবে উর্দুতে “খোশখত” বা “খুতুতি” বলা হয় ক্যালিগ্রাফিকে, তুর্কী ভাষায় ক্যালিগ্রাফিকে বিশেষভাবে “রুহী হান্দেজ” অর্থাৎ অধ্যাত্মিক রেখাঙ্কন বলা হয় এবং ক্যালিগ্রাফি শিল্পীকে “হাত্তাত” সম্বোধন করা হয়। আব্বাসীয় আমলে (৭৫০-১২৫৮ খৃ.) ইসলামী ক্যালিগ্রাফির শিল্পমান পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভে সমর্থ হয়। সে সময় একজন কাতিব ও একজন খাত্তাতের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। একজন কাতিব শুধু কুরআন অনুলিপি বা কোন টেক্সট লিখেই দায়িত্ব শেষ করতেন এবং শুধুমাত্র একটি বা দু’টি লিপিতে তিনি পেশাদার হতেন। কিন্তু একজন ক্যালিগ্রাফার বা খাত্তাত প্রচলিত সবগুলো লিপিতে পেশাদার হওয়ার সাথে পুস্তক অলঙ্করণ, বাধাই, রক্ষণাবেক্ষণ-বিপণনের কাজেও সমান দক্ষ হতেন। এ ছাড়া ছাত্রদেরকে লিপির দীক্ষা দিতেন। ক্যালিগ্রাফির গোপন সূক্ষ্ম কৌশল, এর উপরকণসহ যাবতীয় বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের জ্ঞান রাখতেন। প্রতি শতাব্দীতে ক্যালিগ্রাফির সর্বোচ্চ স্বার্থে ক্যালিগ্রাফার বা খাত্তাতগণ এর রক্ষণাবেক্ষণ, লালন-পালন, উন্নয়ন-প্রসারের জন্য নিবেদিত ছিলেন। এবং প্রত্যেক ক্যালিগ্রাফারই এ বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষা প্রদানের সাথে সাথে প্রয়োজনীয় পুস্তকাদী রচনা করেছেন এবং একটি লিপির আবিস্কারের প্রয়াস চালিয়েছেন। এ ছাড়া শিল্পসম্মত “মাস্টারপিস” কুরআনের কপি অনুলিপি করেছেন। ছাত্রদের জন্য প্রচুর “নামুজজ” বা “ওয়াসলি” অর্থাৎ অনুশীলনের জন্য নমুনা ক্যালিগ্রাফি তৈরি করতেন। ছাত্ররা সেটা অনুসরন করে ক্যালিগ্রাফি চর্চা করতেন।
ক্যালিগ্রাফি হচ্ছে হৃদয়ের অব্যক্ত সুষমামণ্ডিত অনুভূতি প্রকাশের একটি উৎকৃষ্ট মাধ্যম। লিপির উৎপত্তির বিষয়ে বিভিন্ন সুত্র থেকে জানা যায়, প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার (বর্তমান ইরাক) সুমেরিয়ায় লিপির উৎপত্তি হয়েছে। আসলে লিপির উৎপত্তি সম্পর্কে সবগুলো ঐতিহাসিক সুত্র ধারণা প্রসূত। এজন্য তাদের মধ্যকার মতামতগুলোও বিভিন্ন রকমের।
গবেষক ও গ্রন্থকার মার্শাল ক্লারফিল্ড বলেন, বহিঃজগতের প্রাগ্রসর কোন সত্তা (আনুনাকি) মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। ক্লারফিল্ড তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, বহিঃজগতের কোন অচেনা কিছু (এলিয়েন) সৃষ্টি তত্ত্ব বা জিনতত্ত্বের কর্মকৌশল (জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং) ব্যবহার করে আড়াই লাখ বছর পূর্বে মানুষ সৃষ্টি করেছেন।১
ড. শারলে জে রোলিনসন বলেন, ৪০ হাজার বছর পূর্বে ইসরাইলে পাথরের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে মানুষ কাজকর্ম করত।২
প্রাচীন মানব সভ্যতার অস্তিত্বের অধিকাংশ তথ্য-উপাত্ত ও প্রত্মতাত্ত্বিক উপাদান মাধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক। খৃস্টপূর্ব ৪ হাজার ৩৫০০ বছর পূর্বে মেসোপটেমিয়ায় নূহের বন্যার কথা আমরা জানতে পারি।৩ হযরত নূহ (আঃ)-এর চারপুত্র শাম, হাম, ইয়াফস (জাপথ) ও কেনান। কেনান আল্লাহর প্রতি ঈমান না আনার জন্য ডুবে মরে।৪ বর্তমান সিরিয়া, ইসরাইল ও জর্ডানের মধ্যবর্তী এলাকায় কেনান নামক স্থানে ফনেসিয়ান (কানানাইট) লিপি খৃস্টপূর্ব ১১শ’ বছর পূর্বে বিদ্যমান ছিল। ঐতিহাসিক ভিত্তিতে আরবী লিপির উৎপত্তি (অরিজিন) খুঁজতে গেলে দেখা যায় একটি সূত্র বলছে, আরবী হরফ এমনকি লাতিন লিপির জননী হচ্ছে ফনেসীয় লিপি। অর্থাৎ ফনেসীয়রাই প্রথম লিপির আবিস্কার করে।৫ লেবানন, ফিলিস্তিন এবং সিরিয়ার উপকুলীয় অঞ্চলে ফনেসীয়রা বাস করতো। তারা নৌপথে ভূমধ্যসাগরীয় জাতিসমূহের সাথে বাণিজ্য করত। ফলে ফনেসীয়দের লিপি ব্যাপকভাবে এসব মেডিটেরিয়ান জাতির ওপর প্রবল প্রভাব ফেলে। প্রাচীন বিশ্বের (পূর্ব ও পশ্চিম) একক কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্য। খৃস্টপূর্ব ১৩শ বছর আগে প্রাথমিক ফনেসীয় লিপি। [২২টি ব্যঞ্জন হরফ, যাতে কোন বড় হাতের (ক্যাপিটাল) হরফ ছিলো না এবং ডান থেকে বামে লেখা হতো] লেবাননের উপকূলীয় শহর বাইবলসে জন্মেছিলো। খৃস্টপূর্ব ১১ শতকে আরামাইক লিপি ফনেসীয় লিপি থেকে আরামে (সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়া) বিকশিত হয়। যেটা আরামীয় ভাষার প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। খৃস্টপূর্ব ১শ বছর পূর্বে নাবাতীয় লিপি বর্তমান জর্দানের প্রাচীন লালগোলাপ রং (রেডরোজ) শহর পেত্রায় (লোহিত সাগর থেকে উত্তরে অবস্থিত) জন্মগ্রহণ করে। এই লিপিটি মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে প্রসার লাভ করে। ১শ’ খৃস্টাব্দে সিরীয় (সিরিয়াক) লিপির (২২ হরফ সম্বলিত) মেসোপটেমিয়ায় জন্ম হলেও আরামাইকদের মাধ্যমে সেটার উন্নয়ন ঘটে। ঈসায়ী ১ম শতকের মধ্যভাগে প্রাথমিক আরবী লিপির উৎপত্তিস্থল হচ্ছে কুফা (ইরাকের প্রাচীন নগরী)। প্রাচীন কুফী (কৌনিক কুফী) ১৭টি হরফকৃতি বিশিষ্ট ছিল (কোন স্বরচিহ্ন, পৃথকীকরণ ফোটা বা উচ্চারণ ভিন্নতার চিহ্ন তাতে ছিলো না)। কিন্তু ইসলামের অভ্যুদযের সাথে সাথে আরবী হরফের সংখ্যা দাড়ায় ২৯টিতে (হামজাসহ)। ৭ম শতকে পবিত্র কুরআনের লিপি হিসেবে আরবী লিপির একটি বৈজ্ঞানিক সুসংহত ও শৈল্পিক অবয়ব প্রতিষ্ঠিত হয়।৬ অন্য সূত্র থেকে আমরা জানতে পারি সেমেটিক ভাষা জাতির অন্তর্ভূক্ত হচ্ছে- আককাদিয়ান বা ব্যবিলনিয়ান, অ্যাসিরিয়ান, আরামাইক (সিরিয়াক, মান্দিয়ান ও নাবাতিয়ান), ফনেসীয়ান বাইবেলিকান হিব্র“, কানানাইট, আরবী, সাবিয়ান বা হিমিয়ারী হাকিল, গেজ বা ইথোপীয় ভাষা বর্ণেও লোকেরা। পবিত্র কুরআনের যে ঐতিহ্যবাহিী ভাষা ও লেখন রীতি, সেটা উত্তর আরবীয়দের ভাষায় (আল আরব আল মুস্তারিবা) লেখা হয়েছে। আর উত্তর আরবীয়রা হযরত ইব্রাহীমের পুত্র হযরত ইসমাঈলের ভাষা রীতিতে কথা বলত।৭ আরবী লিপির উৎপত্তি পবিত্র কুরআন অনুসারে হযরত আদম (আঃ) প্রতি দিকনির্দেশ করে। সূরা বাকারার (২য় সূরা) ৩১নং আয়াতে বলা হয়েছে, “আর আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) শিখালেন আদমকে সমস্ত বস্তু-সামগ্রীর নাম। তারপর সেসব বস্তু-সামগ্রীকে ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। অতঃপর বললেন, আমাকে তোমরা এগুলোর নাম বলে দাও, যদি তোমরা সত্য হয়ে থাকে।” সূরা বাকারার ২য় আয়াতে বলা হয়েছে,“এটি এমন এক কিতাব (পবিত্র কুরআন) যাতে সন্দেহ সংশয়ের কোন অবকাশ নেই।” এ আয়াতে কিতাব শব্দটি কাতাবা থেকে এসেছে অর্থাৎ লিখিত বস্তু। কাতাবা শব্দটি বিভিন্নভাবে ও রূপে পবিত্র কুরআনে ৩১৯ বার এসেছে। পবিত্র কুরআনসহ প্রধান চারটি ঐশী গ্রন্থকে কিতাব বলে উল্লে¬খ করা হয়েছে। সুতরাং নিঃসন্দেহে লেখনীর ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের শুধু নয় বং মানব সৃষ্টি তথা পৃথিবীতে মানবের আগমনের সাথে লেখার বিষয়টি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আমরা জেনেছি পবিত্র কুরআন যেমন আরবী ভাষায় (আরবী লিপিতে) অবতীর্ণ হয়েছে।৮ তেমনিভাবে তাওরাত অবতীর্ণ হয়েছে ইবরানী (হিব্র“) ভাষায়, যাবুর অবতীর্ণ হয়েছে ইউনানী (গ্রীক) ভাষায় এবং ইঞ্জিল অবতীর্ণ হয় সুরইয়ানী (সিরিয়াক) ভাষায়। নূহ (আঃ)-এর তিন পুত্র শাম, হাম . ইয়াফসকে যথাক্রমে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের জনগোষ্ঠীর পূর্ব-পুরুষ ধরা হয়।৯ শামের বংশধরদের সেমেটিক রূপে গণ্য করা হয়। আর আরাম, আসুর এবং অন্যান্য যেমন- বাইবেল এদের আরব, আরামিয়ান, আসিরিয়ান, ব্যবিলনিয়ান, চাাঁদিয়ান, সাবায়িয়ান, হিব্র“ ইত্যাদি ভাষা গোত্রের লোকেরাই শামের বংশধরদের অন্তর্ভূক্ত।১০ অন্য একটি সূত্র থেকে জানা যায়, খৃস্টপূর্ব ৩ হাজার বছর পূর্বে নদী তীরবর্তী ভেজা নরম মাটিতে কোন মানুষ হয়ত খেয়ালের বশে আনমনে দাগ কেটেছিল। সেটা থেকেই লিখন পদ্ধতির জন্ম হয়। সেই দাগগুলো গোঁজ বা ছাতিওয়ালা বড় পেরেক কিংবা কীলকাকার সদৃশ দেখতে। মোটকথা সরল রেখার মাথায় ত্রিভুজাকৃতির মত বসিয়ে, এই লেখনরীতি কিউনিফর্ম লিপি হিসেবে পরিচিতি পায়।১১ আরবীতে যাকে আল খত আল মাসমারী বলা হয়। পূর্বেই উলে¬খ করা হয়েছে, আদম (আঃ) কে আল্ল¬াহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) সব বস্তুর নাম শিখিয়েছেন, নবী আদমের (আঃ) কাছ থেকে পুত্র শীষ (আঃ) আরবী লেখা আয়ত্ত করে চর্চা করেন।১২ হযরত আবদুল্ল¬াহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন, হযরত ঈসমাইল (আঃ) মাত্র ১৪ বছর বয়সে আরবী ভাষা বলতে ও লিখতে সক্ষম হয়েছিলেন।১৩ সুতরাং হযরত আদম (আঃ) কেই আরবী হরফের আবিষ্কর্তা বলতে পারি তারপর শীষ (আঃ) এবং ইসমাঈল (আঃ) একে যথাযথ পর্যায়ে নিয়ে এসেছিলেন। তবে বেশ কয়েকজন গবেষক হযরত ইদরিস (আঃ) কে আরবী হরফের আবিষ্কর্তা বলে মত ব্যক্ত করেছেন। তিনি মাকালী বৈশিষ্ট্যের আরবী লিপির জনক ছিলেন।১৪ প্রাচীন আরবীর সমসাময়িক কয়েকটি ভাষা বেশ প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। সেগুলো হচ্ছে, সুরইয়ানী (সিরিয়াক) , আরামাইক, গ্রীক, ইথোপীয়, ফারসী, সংস্কৃত ও কিবতী১৫ ভাষা।
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত প্রাচীন নাবাতী আরবী লিপির নমুনা হচেছ, ২৫০ খৃস্টাব্দে উম্মুল জিমালের সমাধি গাত্রের প্রস্তরফলক।১৬ মধ্য ফোরাত অঞ্চলের আরব ভূমির রাজধানী ছিল হিরা। অবশ্য ইতিহাসবিদগণের অনেকেই এর সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন। এই উত্তর আরব ভূমির ২৫জন শাসকের উল্লে¬খ পাওয়া যায় ইতিহাসে। এদের মধ্যে প্রথম দিকের শাসক ইমরাউল কায়েস বিন আমর বিন আদি (২৮৮-৩২৮খৃ.) এবং আরেকজন হচ্ছেন নোমান বিন মুনযির (৫৮০-০২খৃ.)। আল দুরুজ পর্বতের নাম্মারাহ নামক স্থানে ইমরাউল কায়েসের সমাধিফলক পাওয়া যায়। এটির ভাষাও নাবাতী আরবী। ১৭
৫১২ খৃস্টাব্দে জাবাদে প্রাপ্ত শিলালিপিটিতে গ্রীক, সিরিয়াক ও আরবী ভাষায় লেখা হয়েছে, জাবাদ হচ্ছে বর্তমান পূর্ব-দক্ষিণ হালিব, যেটা ফোরাত নদীর তীরে অবস্থিত। এই শিলালিপিতে তারিখ লেখা হয়েছে গ্রীক ভাষায়।১৮ কয়েকটি শিলালিপির কথা এখানে উল্লেখ করা হলো। এ ছাড়া আসিস শিলালিপি (৫২৮ খৃ.), ফাররান উপত্যকা শিলালিপি (২৩০ খৃ.), তুরে সিনাই শিলালিপি (২৫৩ খৃ.), মাদায়েন সালেহ শিলালিপি (৫৬৮ খৃ.) প্রভৃতির প্রমাণ আমাদের সামনে রয়েছে। এগুলো ব্যতিরেকে বহুকিছুই আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে রয়ে গেছে। আরব ইতিহাসবিদগণ বলছেন, হযরত আদম (আঃ) সর্বপ্রথম পৃথিবীতে লিপি নিয়ে আসেন। আর নূহের (আঃ) মহাপ্ল¬াবনের পর হযরত ইসমাঈল (আঃ) সে লিপি উদ্ধার করেন। অথবা সে লিপিকে আরবরা হিরা থেকে, আর হিরাবাসী আম্বর থেকে, আম্বরের অধিবাসীরা ইয়ামন থেকে, সেখানকার আরবরা সেটা আরেবাহ থেকে, যেটা তারা আদনান ভূমি থকে এনেছিল।১৯
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সময়ে উত্তর আরবীয় লিপিতে কুরআন লেখা হয়। সে লিপিতে হরফের স্বাতন্ত্র্য পরিচয় রক্ষার জন্য ফোটার (নোকতা) ব্যবহার করা হয়। আব্বাসীয় আমলে এসে তাতে জের, জবর, পেশ প্রভৃতি হরকতের ব্যবহার করা হয়।
এখানে লেখ্য আরবীলিপির বিষয়ে একটু বলা প্রয়োজন মনে করছি। দুটো প্রধান ধারায় লেখ্য আরবীলিপির ব্যবহার চালু রয়েছে। এক. ক্লাসিক বা ঐতিহ্যিক আরবী, এটা মূলত কুরআন এবং ঐতিহ্যিক সাহিত্যের ভাষা। এটা আধুনিক মানসম্পন্ন আরবী ভাষার সাথে স্টাইল ও উচ্চারণগত পার্থক্য নির্দেশ করে। পবিত্র কুরআনের ভাষা ও লেখনরীতি যেটাকে এর ভিত্তি ধারা হয় এবং এর বহু তাফসির অর্থাৎ ব্যাখ্যা এবং বিশদ আলোচনামূলক রচনা আধুনিক আরবীতে করা হয়েছে। দুই. আধুনিক আদর্শমান (স্ট্যান্ডার্ড) আরবী এটা বিশ্বব্যাপী পরিচিতও আধুনিক আরব দেশগুলোর সকল মানুষের বোধগম্য আদর্শমান আরবী ভাষা। এই আরবীর অধিকাংশ হচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যবহৃত বক্তৃতা, পুস্তক এবং টিভি শো'তে ব্যবহৃত ভাষা। এছাড়া প্রতিটি আরবীভাষী দেশের মধ্যে স্থানীয়ভাবে কিছু নিজস্ব উচ্চারণ ও স্বাতন্ত্র্য লেখন রীতিরও দেখা মেলে। কবিতা, সাহিত্য, কার্টুন ও কমিক্স-এ এই বিচিত্র স্থাণিকতার প্রয়োগ দেখা যায়।২০
আরবী লিপির ক্যালিগ্রাফিতে প্রকাশ মূলতঃ পবিত্র কুরআন অনুলিপির মাধ্যমে শুরু হয়। আরবী লিপির উন্নয়ন, প্রসার-প্রাচারে রাসূল মুহাম্মদ (সাঃ) নিজে নিরক্ষর হলেও তাঁর সীলমোহরটি ক্যালিগ্রাফির প্রথম নমুনা হিসেবে উল্লে¬খ করতে হয়। কারণ আরবীলিপির যে লিখনরীতি যেমন ডান থেকে বামে এবং ছত্রগুলো উপর থেকে নিচে নিম্নগামী। যেটা সে সময়ের তথ্য-প্রমাণে আমরা দেখতে পাই। কিন্তু রাসূলের (সাঃ) সীলমোহরটি এই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম এবং ক্যালিগ্রাফির প্রথম কম্পোজিশন ধারণার প্রমাণ। এতে উল্লম্বভাবে উপর-নীচ তিনটি শব্দ রয়েছে। আল্ল¬াহ-রাসূল-মুহাম্মদ ।২১ যদি উপর থেকে পড়ে যাই তাহলে বাক্য শুদ্ধ হয় না। অথচ এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। এখানে পড়তে হবে নীচ থেকে ওপরে অর্থাৎ মুহাম্মদ রাসূল আল্লাহ, এখন বাক্য হল, আর অর্থ ঠিক হচ্ছে অর্থাৎ মুহাম্মদ (সাঃ) আল্ল¬াহর রাসূল। এই মোহরে সর্বপ্রথম আমরা সাধারণ নিয়মের ব্যত্যয় দেখি। এর মূল কারণ হচ্ছে আ¬ল্লাহ শব্দকে উপরে রাখা। এটা অনুসরণ করে পরবর্তী সমস্ত ক্যালিগ্রাফির কম্পোজিশনে আল্লাহ শব্দকে উপরে রাখা হয়। যতটুকু জানা যায়, আরবী লিপির প্রথম কাতিব ছিলেন মারামিররাহ বিন মিররাহ এবং আসলাম বিন সাদরাহ, তারা দু’জন আম্বরের অধিবাসী ছিলেন। তবে যিনি আম্বর থেকে নাবাতীলিপি এনে মক্কায় মানুষদের শিখিয়েছিলেন, তার নাম হচ্ছে বিশর বিন আবদুল মালিক। তিনি আবু সুফিয়ানের বোন সুহবা বিনতে হারবের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার প্রচেষ্টায় লিপিটি আরবী গঠনে সংস্কার হয় এবং হেযাযে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়। রাসূলের সাহাবীদের মধ্যে ওসমান বিন আফফান ও মারওয়ান বিন হাকাম ইসলাম পূর্ব সময়ে ছোটবেলায় একই মক্তবে আরবী লেখা শিখেন। এছাড়া মুয়াবিয়া বিন আবু সুফইয়ান, আলী বিন আবু তালিব ও যায়েদ বিন সাবিত আল আনসারী আম্বারী লিপিকারদের চেয়েও সুন্দর করে লিখতে পারতেন।
ওহী অবতীর্ণের সাথে সাথে তা লিখে রাখার জন্য রাসূল (সাঃ) বিশেষভাবে কয়েকজন সাহাবীকে নিয়োগ দিয়েছিলেন।২২ এছাড়া মুসলিম মহিলাদের লেখাপড়া শিক্ষা দেয়ার জন্য হাফসাকে [রাসূলের (সাঃ) স্ত্রী] নির্দেশ দেন। ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদরে বিজিত কুরাইশ বন্দীদের মুক্তিপণস্বরূপ ১০ জন মুসলিমকে লেখাপড়া শেখানোর শর্ত প্রদান করেন। এদের মধ্যে হাফিনাহ আল নাসরানী অন্যতম। মদিনায় ইহুদীদের সন্তানেরা লেখাপড়া শিক্ষার জন্য যায়েদ বিন সাবিত আল আনসারীর কাছে আসত। রাসূল (সাঃ) যায়েদকে সহায়তার জন্য উবাই বিন কাব, উসাইদ বিন হুদাইর, বিশর বিন সাঈগ ও মা’আন বিন আদিকে নির্দেশ দেন। তারা ব্যাপকভাবে মানুষদেরকে লেখাপড়া শেখানোর প্রয়াস অব্যাহত রাখেন।
পবিত্র কুরআনে লেখার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আজকাল লেখালেখির যুগ। লেখাই মুখের কথার স্থালাভিষিক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু চৌদ্দশ’ বছর পূর্বের দিকে তাকিয়ে দেখুন। তখন দুনিয়ার সব কাজ কারবার ও ব্যবসা বাণিজ্য মুখে মুখেই চলতো, লেখালেখি এবং দলিল দস্তাবেজের প্রথা প্রচলন ছিল না। সর্বপ্রথম কুরআন পাক এদিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বলা হয়েছে, "তোমরা যখন পরস্পর নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ধার কর্জের কারবার কর, তখন তা লিখে নাও।”২৩ আল্ল¬াহ (সুবহানাহুওয়া তায়ালা) বলেন, আর তার [হযরত মুসা (আঃ)] জন্য তখতীতে (লেখার জন্য মসৃণ সমতল পৃষ্ঠ সম্বলিত পাথর, কাঠ, মাটির প্রভৃতির প্যালেট) লিখে দিয়েছি সর্বপ্রকার উপদেশ ও বিস্তারিত সব বিষয়।”২৪ পবিত্র কুরআনে সূরা কলম ও সূরা আলাকে যথাক্রমে কলমের শপথ ও কলমের মাধমে মানুষকে শিক্ষা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। রাসূল (সাঃ) সুন্দর হস্তলিখনের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বলেন, ”তোমরা লেখনীর মাধ্যমে জ্ঞানকে ধারণ কর।”২৫ “পিতা-মাতার কাছে সন্তানের (৩টি) অধিকার রয়েছে, প্রথমতঃ সন্তানকে উত্তম লেখা শেখাবে, দ্বিতীয়তঃ তার একটা সুন্দর নাম রাখবে এবং তৃতীয়তঃ প্রাপ্ত বয়স্ক হলে তাকে বিবাহ দেবে।”২৬ রাসূল (সাঃ) আরো বলেন, “উত্তম হাতের লেখা সত্যের উজ্জ্বলতাকে বাড়িয়ে দেয়।”২৭
ইসলামের আবির্ভাবের প্রথমদিকে যে টানা ধরনের লেখা ছিল সেটাকে “লায়িন” নামে অভিহিত করা হয়। সামনে ঝুঁকানো রেখা ও দ্রুত লেখার এ মোলায়েম স্বভাবের আরেকটি লিপি বেশ জনব্যবহৃত ছিল, লিপিটি মোটা ডগা বিশিষ্ট কলমে লেখা হতো। “ইয়াবিস” নামে কর্কশ স্বভাবের আরেকটি লিপির প্রচলন ছিল। সেটা মূলত ট্যান করা চামড়ায় কিংবা পাথরের বা খেজুর পাতে খোদাই করে লেখা হতো। পবিত্র কুরআন অনুলিপিতেও এই লিপির ব্যবহার হত।২৮ পরবর্তীতে উমাইয়া আমলে (৬৬১-৭৫০ খৃ,) লায়িন লিপি থেকে ক্যালিগ্রাফি লেখার উদ্ভব হয়। উমাইয়া আমলে একটি বিস্ময়কর আরবী লিপির উদ্ভব ঘটে। অত্যন্ত নিবিড়ভাবে ও সূক্ষ্ম বাঁক সম্বলিত এবং লিখতে কম জায়গা লাগে, এ লিপির নাম হচ্ছে মাশক লিপি। যদিও গবেষকগণ বলেন, এটি তার আসল নাম নয়, বাহরাইনের বাইতুল কুরআন মিউজিয়ামে এর একটি চমৎকার নিদর্শন রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন দলিল দস্তাবেজ ও তথ্যাদি থেকে জানা যায়, সে সময় আরবী লিপির বেশ কয়েক প্রকার স্টাইল ব্যবহার হতো।২৯ তবে একথা অস্বীকার করা যায় না যে, উমাইয়া আমলেই প্রথমবারের মত লেখার দৃষ্টিকোণ থেকে পরিপক্ক ক্যালিগ্রাফিতে উত্তরণের দৃষ্টান্ত খুঁজে পাই। বায়তুল মুকাদ্দাসের কুব্বাতুছ ছাখরা মসজিদের গম্বুজের চারদিক ঘিরে উৎকীর্ণ করে লেখা পবিত্র কুরআনের আয়াতগুলো হিজরী প্রথম শতাব্দীর ক্যালিগ্রাফির নিদর্শন হিসেবে এখনও টিকে আছে। বস্তুত এসব ক্যালিগ্রাফি ছিল শিল্পকলার জগতে এক নতুন উদ্ভাবন। মোজাইক টালির ওপরকার এ ক্যালিগ্রাফিগুলো পুরোপুরি পাঠযোগ্য এবং পবিত্র কুরআনের আয়াতের সর্বপ্রথম শিল্পসম্মত বড় আকারের লেখা। ইসলামের ইতিহাসে ১শ বছর পূর্ণ না হতেই হিজরী ৭ম দশকে এ ধরনের চমৎকার ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম তৈরী নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর ব্যাপার। গম্বুজের চারপাশ ঘিরে এই ক্যালিগ্রাফি স্থাপনের দর্শনগত ধারণাও অত্যন্ত গুরুত্বের দাবি রাখে। কারণ এটা অসীমত্বের বোধ জাগ্রত করে। অর্থাৎ আল্ল¬াহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) যে অসীম, তা এই ক্যালিগ্রাফি দেখে অনুভব করা যায়। ইসলামী ক্যালিগ্রাফি বিভিন্ন মাধ্যমে সম্প্রসারিত হয়। কাগজে, পার্চমেন্টে, অর্থাৎ বই পুস্তক রচনায় শৈল্পিক ব্যবহার যেমন শুরু হয়, তেমনি স্থাপত্য ক্যালিগ্রাফির বিষয়টি মুসলিম শিল্পীদের একান্ত নিজস্ব উদ্ভাবন। এতে লিপির উপযোগিতা ও ব্যবহার তাদের সুচিন্তিত শৈল্পিক মানসের প্রকাশ ঘটিয়েছে। স্থাপত্যের কর্কশ ও শক্ত স্বভাবের জন্য কৌনিক ধারার লিপি যেমন কুফি লিপি এবং কুফি লিপির স্থানীয় প্রকার যেমন আন্দালুসী কুফির ব্যবহার শিল্পবোদ্ধাদের মুগ্ধ করেছে। উমাইয়া আমলের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফি শিল্পীদের অন্যতম হচ্ছেন যাহহাক ইবনে আজলান ও ইউসুফ ইবনে হাম্মাদ। তাদের জীবনের ব্রত ছিল ক্যালিগ্রাফিকে শিল্পনৈপুণ্যের শীর্ষে নিয়ে যাওয়া। তারা ব্যবসায়িক লক্ষ্যে কখনও শিল্পকর্ম তৈরি করতেন না। এ জন্যই মাত্র হিজরী ৩য় শতকের শেষ দিকে ইসলামী ক্যালিগ্রাফির গোটা প্রাসাদ পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করে। কারণ সে সময় বিপুল সংখ্যায় পবিত্র কুরআনের অনুলিপি হয় এবং সেটাতে বিভিন্ন মাত্রায় শৈল্পিক নিপুণতা প্রয়োগ করা হয়। এতে করে লিখিত উপকরণাদির বেচাকেনা শুরু হয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্মের প্রতি প্রবল আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। বাণিজ্যিকভাবে শিল্পকর্মের উপকরণাদি উৎপাদিত হতে থাকে। ক্যালিগ্রাফি নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা প্রচলিত হয় এবং এ শিল্পকলাকে সুন্দর প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান বলে গণ্য করা হতে থাকে। ফলে সম্পূর্ণ নতুন একটি ক্ষেত্র অর্থাৎ গ্রন্থাগার সমৃদ্ধ করা, পেশাজীবী, পেশাদার, সৌখিন শিল্পী, শিল্পকলার বিচারক এবং শিল্পকর্ম ও শিল্পে ব্যবহার্য উপকরণাদির বিক্রির জন্য বাজারের সৃষ্টি হয়।৩০ শিল্পকর্মের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ব্যাপকভাবে ক্যালিগ্রাফি তৈরি শুরু হয়। সহজ মাধ্যম হিসেবে কাগজে, প্যাপিরাসে শিল্পীরা ক্যালিগ্রাফি করতে থাকেন। ধীরে ধীরে ঝিল্ল¬ী ও চামড়ার ব্যবহার উঠে যায়। আব্বাসীয় যুগের (৭৫১-১২৫৮ খৃ.) প্রথমদিকেই পবিত্র কুরআনের জন্য কয়েকটি লিপি যেমন- নাসখী, রিকা, সুলুস, রায়হানী, মুহাক্কাক প্রভৃতি নির্দিষ্ট হয়ে যায়। অনুরূপভাবে কুরআন বহির্ভূত বিভিন্ন বিষয়ের জন্য পৃথক পৃথক স্টাইলের লিপির ব্যবহারও প্রায় নির্দিষ্ট হয়ে যায়। বস্তুত বই-পুস্তক লেখার জন্য অধিকতর সুস্পষ্ট ও সহজ পঠনযোগ্য, বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোন থেকে মুক্ত ও সাংস্কৃতিক বিকাশের দাবি পূরণকারী এসব লিপির উদ্ভাবন ছিল অপরিহার্য। সহজ লিখনযোগ্য ও বিশেষ ব্যবহারের লক্ষ্যে উদ্ভাবিত এসব লিপি আলাদা আলাদাভাবে সরকারী দলিল-দস্তাবেজ, চিঠিপত্র, কেনাকাটার তালিকা, শ্রবণ থেকে অনুলিখন, এমনকি কবুতরের মাধ্যমে প্রেরণের চিঠির জন্য লেখা হতো। আব্বাসীয় আমলেই বাগদাদ ক্যালিগ্রাফি উৎপাদনের কারখানা স্বরূপ গড়ে উঠে। বাগদাদের এসময়কার ক্যালিগ্রাফি শিল্পের শৈল্পিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ সম্পর্কে ইয়াসির তাব্বা একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। সত্যিকার চারুকলার বিষয় হিসেবে ক্যালিগ্রাফিকে (ক্লাসিক অর্থে) সুসংহত করেন রাজনীতিবিদ, কবি ও ক্যালিগ্রাফি শিল্পী আবু আলী ইবনে মুকলা (মৃ. ৯৪০খৃ.) এবং তার ভাই ও ক্যালিগ্রাফি শিল্পী আবু আব্দুল্লাহ ইবনে মুকলা (মৃ. ৯৪৯ খৃ.)। তারা দু’ভাই ক্যালিগ্রাফিকে আনুপাতিক লেখনীতে বিন্যস্ত এবং একে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেন। যেটা ক্যালিগ্রাফির শিল্পমানকে উত্তরোত্তর শাণিত করে। ইবনে মুকলার ছাত্র আলী ইবনে হিলাল ইবনে বাওয়াব (মৃ. ১০২২ খৃ.) হচ্ছেন ইসলামের ইতিহাসে দর্শনীয় শিল্পকর্মের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী। একাধারে অভ্যন্তরীণ চিত্রকর (Interior Painter) ও ক্যালিগ্রাফির প্রতি অত্যন্ত একনিষ্ঠ হওয়ায় ইবনে বাওয়াব এ শিল্পকে শিল্পকলার শীর্ষে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। এছাড়া ইয়াকুত আল মুস্তাসিমী (মৃ. ১২৯৮ খৃ.) ক্যালিগ্রাফির ট্রেডিশনাল ধারাকে সঠিক মাপে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং ভবিষ্যত শিল্পকলায় লিভিং আর্ট হিসেবে একে স্থাপন করেন।যুগের পরিক্রমায় ইসলামী ক্যালিগ্রাফি পশ্চিমে মাগরিব বা মরক্কো থেকে পূর্বে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত একটি প্রভাব বিস্তারকারী শিল্পধারা হিসেবে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখে। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে বিস্তার লাভের পর এতে নানামুখী স্টাইল ও ধারা যেমন জন্মলাভ করে তেমনি সাংস্কৃতিক বিকাশে স্থানীয় উপায়-উপকরণকে আত্মস্থের মাধ্যমে এটি বিস্ময়কর শিল্পে রূপলাভ করে। এ শিল্পের সংস্কার সাধনে প্রায় প্রতি শতাব্দীতে প্রয়াস চালাতে হয়েছে। ১৩৮০ খ্রীস্টাব্দে আনাতোলিয়ার বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফির ওস্তাদ ও শিল্পী সেইহ্ হামদুল্ল¬াহ ক্যালিগ্রাফির পূর্ণাঙ্গ সংস্কার সাধনে ব্রতী হন এবং মাত্র দুই বছরে তিনি এর যাবতীয় খুঁটিনাটি বিন্যস্ত করেন এবং সাফল্যের সাথে একে পূর্ণতা দান করেন।
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত প্রাচীন নাবাতী আরবী লিপির নমুনা হচেছ, ২৫০ খৃস্টাব্দে উম্মুল জিমালের সমাধি গাত্রের প্রস্তরফলক।১৬ মধ্য ফোরাত অঞ্চলের আরব ভূমির রাজধানী ছিল হিরা। অবশ্য ইতিহাসবিদগণের অনেকেই এর সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন। এই উত্তর আরব ভূমির ২৫জন শাসকের উল্লে¬খ পাওয়া যায় ইতিহাসে। এদের মধ্যে প্রথম দিকের শাসক ইমরাউল কায়েস বিন আমর বিন আদি (২৮৮-৩২৮খৃ.) এবং আরেকজন হচ্ছেন নোমান বিন মুনযির (৫৮০-০২খৃ.)। আল দুরুজ পর্বতের নাম্মারাহ নামক স্থানে ইমরাউল কায়েসের সমাধিফলক পাওয়া যায়। এটির ভাষাও নাবাতী আরবী। ১৭
৫১২ খৃস্টাব্দে জাবাদে প্রাপ্ত শিলালিপিটিতে গ্রীক, সিরিয়াক ও আরবী ভাষায় লেখা হয়েছে, জাবাদ হচ্ছে বর্তমান পূর্ব-দক্ষিণ হালিব, যেটা ফোরাত নদীর তীরে অবস্থিত। এই শিলালিপিতে তারিখ লেখা হয়েছে গ্রীক ভাষায়।১৮ কয়েকটি শিলালিপির কথা এখানে উল্লেখ করা হলো। এ ছাড়া আসিস শিলালিপি (৫২৮ খৃ.), ফাররান উপত্যকা শিলালিপি (২৩০ খৃ.), তুরে সিনাই শিলালিপি (২৫৩ খৃ.), মাদায়েন সালেহ শিলালিপি (৫৬৮ খৃ.) প্রভৃতির প্রমাণ আমাদের সামনে রয়েছে। এগুলো ব্যতিরেকে বহুকিছুই আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে রয়ে গেছে। আরব ইতিহাসবিদগণ বলছেন, হযরত আদম (আঃ) সর্বপ্রথম পৃথিবীতে লিপি নিয়ে আসেন। আর নূহের (আঃ) মহাপ্ল¬াবনের পর হযরত ইসমাঈল (আঃ) সে লিপি উদ্ধার করেন। অথবা সে লিপিকে আরবরা হিরা থেকে, আর হিরাবাসী আম্বর থেকে, আম্বরের অধিবাসীরা ইয়ামন থেকে, সেখানকার আরবরা সেটা আরেবাহ থেকে, যেটা তারা আদনান ভূমি থকে এনেছিল।১৯
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সময়ে উত্তর আরবীয় লিপিতে কুরআন লেখা হয়। সে লিপিতে হরফের স্বাতন্ত্র্য পরিচয় রক্ষার জন্য ফোটার (নোকতা) ব্যবহার করা হয়। আব্বাসীয় আমলে এসে তাতে জের, জবর, পেশ প্রভৃতি হরকতের ব্যবহার করা হয়।
এখানে লেখ্য আরবীলিপির বিষয়ে একটু বলা প্রয়োজন মনে করছি। দুটো প্রধান ধারায় লেখ্য আরবীলিপির ব্যবহার চালু রয়েছে। এক. ক্লাসিক বা ঐতিহ্যিক আরবী, এটা মূলত কুরআন এবং ঐতিহ্যিক সাহিত্যের ভাষা। এটা আধুনিক মানসম্পন্ন আরবী ভাষার সাথে স্টাইল ও উচ্চারণগত পার্থক্য নির্দেশ করে। পবিত্র কুরআনের ভাষা ও লেখনরীতি যেটাকে এর ভিত্তি ধারা হয় এবং এর বহু তাফসির অর্থাৎ ব্যাখ্যা এবং বিশদ আলোচনামূলক রচনা আধুনিক আরবীতে করা হয়েছে। দুই. আধুনিক আদর্শমান (স্ট্যান্ডার্ড) আরবী এটা বিশ্বব্যাপী পরিচিতও আধুনিক আরব দেশগুলোর সকল মানুষের বোধগম্য আদর্শমান আরবী ভাষা। এই আরবীর অধিকাংশ হচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যবহৃত বক্তৃতা, পুস্তক এবং টিভি শো'তে ব্যবহৃত ভাষা। এছাড়া প্রতিটি আরবীভাষী দেশের মধ্যে স্থানীয়ভাবে কিছু নিজস্ব উচ্চারণ ও স্বাতন্ত্র্য লেখন রীতিরও দেখা মেলে। কবিতা, সাহিত্য, কার্টুন ও কমিক্স-এ এই বিচিত্র স্থাণিকতার প্রয়োগ দেখা যায়।২০
আরবী লিপির ক্যালিগ্রাফিতে প্রকাশ মূলতঃ পবিত্র কুরআন অনুলিপির মাধ্যমে শুরু হয়। আরবী লিপির উন্নয়ন, প্রসার-প্রাচারে রাসূল মুহাম্মদ (সাঃ) নিজে নিরক্ষর হলেও তাঁর সীলমোহরটি ক্যালিগ্রাফির প্রথম নমুনা হিসেবে উল্লে¬খ করতে হয়। কারণ আরবীলিপির যে লিখনরীতি যেমন ডান থেকে বামে এবং ছত্রগুলো উপর থেকে নিচে নিম্নগামী। যেটা সে সময়ের তথ্য-প্রমাণে আমরা দেখতে পাই। কিন্তু রাসূলের (সাঃ) সীলমোহরটি এই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম এবং ক্যালিগ্রাফির প্রথম কম্পোজিশন ধারণার প্রমাণ। এতে উল্লম্বভাবে উপর-নীচ তিনটি শব্দ রয়েছে। আল্ল¬াহ-রাসূল-মুহাম্মদ ।২১ যদি উপর থেকে পড়ে যাই তাহলে বাক্য শুদ্ধ হয় না। অথচ এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। এখানে পড়তে হবে নীচ থেকে ওপরে অর্থাৎ মুহাম্মদ রাসূল আল্লাহ, এখন বাক্য হল, আর অর্থ ঠিক হচ্ছে অর্থাৎ মুহাম্মদ (সাঃ) আল্ল¬াহর রাসূল। এই মোহরে সর্বপ্রথম আমরা সাধারণ নিয়মের ব্যত্যয় দেখি। এর মূল কারণ হচ্ছে আ¬ল্লাহ শব্দকে উপরে রাখা। এটা অনুসরণ করে পরবর্তী সমস্ত ক্যালিগ্রাফির কম্পোজিশনে আল্লাহ শব্দকে উপরে রাখা হয়। যতটুকু জানা যায়, আরবী লিপির প্রথম কাতিব ছিলেন মারামিররাহ বিন মিররাহ এবং আসলাম বিন সাদরাহ, তারা দু’জন আম্বরের অধিবাসী ছিলেন। তবে যিনি আম্বর থেকে নাবাতীলিপি এনে মক্কায় মানুষদের শিখিয়েছিলেন, তার নাম হচ্ছে বিশর বিন আবদুল মালিক। তিনি আবু সুফিয়ানের বোন সুহবা বিনতে হারবের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার প্রচেষ্টায় লিপিটি আরবী গঠনে সংস্কার হয় এবং হেযাযে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়। রাসূলের সাহাবীদের মধ্যে ওসমান বিন আফফান ও মারওয়ান বিন হাকাম ইসলাম পূর্ব সময়ে ছোটবেলায় একই মক্তবে আরবী লেখা শিখেন। এছাড়া মুয়াবিয়া বিন আবু সুফইয়ান, আলী বিন আবু তালিব ও যায়েদ বিন সাবিত আল আনসারী আম্বারী লিপিকারদের চেয়েও সুন্দর করে লিখতে পারতেন।
ওহী অবতীর্ণের সাথে সাথে তা লিখে রাখার জন্য রাসূল (সাঃ) বিশেষভাবে কয়েকজন সাহাবীকে নিয়োগ দিয়েছিলেন।২২ এছাড়া মুসলিম মহিলাদের লেখাপড়া শিক্ষা দেয়ার জন্য হাফসাকে [রাসূলের (সাঃ) স্ত্রী] নির্দেশ দেন। ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদরে বিজিত কুরাইশ বন্দীদের মুক্তিপণস্বরূপ ১০ জন মুসলিমকে লেখাপড়া শেখানোর শর্ত প্রদান করেন। এদের মধ্যে হাফিনাহ আল নাসরানী অন্যতম। মদিনায় ইহুদীদের সন্তানেরা লেখাপড়া শিক্ষার জন্য যায়েদ বিন সাবিত আল আনসারীর কাছে আসত। রাসূল (সাঃ) যায়েদকে সহায়তার জন্য উবাই বিন কাব, উসাইদ বিন হুদাইর, বিশর বিন সাঈগ ও মা’আন বিন আদিকে নির্দেশ দেন। তারা ব্যাপকভাবে মানুষদেরকে লেখাপড়া শেখানোর প্রয়াস অব্যাহত রাখেন।
পবিত্র কুরআনে লেখার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আজকাল লেখালেখির যুগ। লেখাই মুখের কথার স্থালাভিষিক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু চৌদ্দশ’ বছর পূর্বের দিকে তাকিয়ে দেখুন। তখন দুনিয়ার সব কাজ কারবার ও ব্যবসা বাণিজ্য মুখে মুখেই চলতো, লেখালেখি এবং দলিল দস্তাবেজের প্রথা প্রচলন ছিল না। সর্বপ্রথম কুরআন পাক এদিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বলা হয়েছে, "তোমরা যখন পরস্পর নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ধার কর্জের কারবার কর, তখন তা লিখে নাও।”২৩ আল্ল¬াহ (সুবহানাহুওয়া তায়ালা) বলেন, আর তার [হযরত মুসা (আঃ)] জন্য তখতীতে (লেখার জন্য মসৃণ সমতল পৃষ্ঠ সম্বলিত পাথর, কাঠ, মাটির প্রভৃতির প্যালেট) লিখে দিয়েছি সর্বপ্রকার উপদেশ ও বিস্তারিত সব বিষয়।”২৪ পবিত্র কুরআনে সূরা কলম ও সূরা আলাকে যথাক্রমে কলমের শপথ ও কলমের মাধমে মানুষকে শিক্ষা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। রাসূল (সাঃ) সুন্দর হস্তলিখনের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বলেন, ”তোমরা লেখনীর মাধ্যমে জ্ঞানকে ধারণ কর।”২৫ “পিতা-মাতার কাছে সন্তানের (৩টি) অধিকার রয়েছে, প্রথমতঃ সন্তানকে উত্তম লেখা শেখাবে, দ্বিতীয়তঃ তার একটা সুন্দর নাম রাখবে এবং তৃতীয়তঃ প্রাপ্ত বয়স্ক হলে তাকে বিবাহ দেবে।”২৬ রাসূল (সাঃ) আরো বলেন, “উত্তম হাতের লেখা সত্যের উজ্জ্বলতাকে বাড়িয়ে দেয়।”২৭
ইসলামের আবির্ভাবের প্রথমদিকে যে টানা ধরনের লেখা ছিল সেটাকে “লায়িন” নামে অভিহিত করা হয়। সামনে ঝুঁকানো রেখা ও দ্রুত লেখার এ মোলায়েম স্বভাবের আরেকটি লিপি বেশ জনব্যবহৃত ছিল, লিপিটি মোটা ডগা বিশিষ্ট কলমে লেখা হতো। “ইয়াবিস” নামে কর্কশ স্বভাবের আরেকটি লিপির প্রচলন ছিল। সেটা মূলত ট্যান করা চামড়ায় কিংবা পাথরের বা খেজুর পাতে খোদাই করে লেখা হতো। পবিত্র কুরআন অনুলিপিতেও এই লিপির ব্যবহার হত।২৮ পরবর্তীতে উমাইয়া আমলে (৬৬১-৭৫০ খৃ,) লায়িন লিপি থেকে ক্যালিগ্রাফি লেখার উদ্ভব হয়। উমাইয়া আমলে একটি বিস্ময়কর আরবী লিপির উদ্ভব ঘটে। অত্যন্ত নিবিড়ভাবে ও সূক্ষ্ম বাঁক সম্বলিত এবং লিখতে কম জায়গা লাগে, এ লিপির নাম হচ্ছে মাশক লিপি। যদিও গবেষকগণ বলেন, এটি তার আসল নাম নয়, বাহরাইনের বাইতুল কুরআন মিউজিয়ামে এর একটি চমৎকার নিদর্শন রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন দলিল দস্তাবেজ ও তথ্যাদি থেকে জানা যায়, সে সময় আরবী লিপির বেশ কয়েক প্রকার স্টাইল ব্যবহার হতো।২৯ তবে একথা অস্বীকার করা যায় না যে, উমাইয়া আমলেই প্রথমবারের মত লেখার দৃষ্টিকোণ থেকে পরিপক্ক ক্যালিগ্রাফিতে উত্তরণের দৃষ্টান্ত খুঁজে পাই। বায়তুল মুকাদ্দাসের কুব্বাতুছ ছাখরা মসজিদের গম্বুজের চারদিক ঘিরে উৎকীর্ণ করে লেখা পবিত্র কুরআনের আয়াতগুলো হিজরী প্রথম শতাব্দীর ক্যালিগ্রাফির নিদর্শন হিসেবে এখনও টিকে আছে। বস্তুত এসব ক্যালিগ্রাফি ছিল শিল্পকলার জগতে এক নতুন উদ্ভাবন। মোজাইক টালির ওপরকার এ ক্যালিগ্রাফিগুলো পুরোপুরি পাঠযোগ্য এবং পবিত্র কুরআনের আয়াতের সর্বপ্রথম শিল্পসম্মত বড় আকারের লেখা। ইসলামের ইতিহাসে ১শ বছর পূর্ণ না হতেই হিজরী ৭ম দশকে এ ধরনের চমৎকার ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম তৈরী নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর ব্যাপার। গম্বুজের চারপাশ ঘিরে এই ক্যালিগ্রাফি স্থাপনের দর্শনগত ধারণাও অত্যন্ত গুরুত্বের দাবি রাখে। কারণ এটা অসীমত্বের বোধ জাগ্রত করে। অর্থাৎ আল্ল¬াহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) যে অসীম, তা এই ক্যালিগ্রাফি দেখে অনুভব করা যায়। ইসলামী ক্যালিগ্রাফি বিভিন্ন মাধ্যমে সম্প্রসারিত হয়। কাগজে, পার্চমেন্টে, অর্থাৎ বই পুস্তক রচনায় শৈল্পিক ব্যবহার যেমন শুরু হয়, তেমনি স্থাপত্য ক্যালিগ্রাফির বিষয়টি মুসলিম শিল্পীদের একান্ত নিজস্ব উদ্ভাবন। এতে লিপির উপযোগিতা ও ব্যবহার তাদের সুচিন্তিত শৈল্পিক মানসের প্রকাশ ঘটিয়েছে। স্থাপত্যের কর্কশ ও শক্ত স্বভাবের জন্য কৌনিক ধারার লিপি যেমন কুফি লিপি এবং কুফি লিপির স্থানীয় প্রকার যেমন আন্দালুসী কুফির ব্যবহার শিল্পবোদ্ধাদের মুগ্ধ করেছে। উমাইয়া আমলের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফি শিল্পীদের অন্যতম হচ্ছেন যাহহাক ইবনে আজলান ও ইউসুফ ইবনে হাম্মাদ। তাদের জীবনের ব্রত ছিল ক্যালিগ্রাফিকে শিল্পনৈপুণ্যের শীর্ষে নিয়ে যাওয়া। তারা ব্যবসায়িক লক্ষ্যে কখনও শিল্পকর্ম তৈরি করতেন না। এ জন্যই মাত্র হিজরী ৩য় শতকের শেষ দিকে ইসলামী ক্যালিগ্রাফির গোটা প্রাসাদ পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করে। কারণ সে সময় বিপুল সংখ্যায় পবিত্র কুরআনের অনুলিপি হয় এবং সেটাতে বিভিন্ন মাত্রায় শৈল্পিক নিপুণতা প্রয়োগ করা হয়। এতে করে লিখিত উপকরণাদির বেচাকেনা শুরু হয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্মের প্রতি প্রবল আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। বাণিজ্যিকভাবে শিল্পকর্মের উপকরণাদি উৎপাদিত হতে থাকে। ক্যালিগ্রাফি নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা প্রচলিত হয় এবং এ শিল্পকলাকে সুন্দর প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান বলে গণ্য করা হতে থাকে। ফলে সম্পূর্ণ নতুন একটি ক্ষেত্র অর্থাৎ গ্রন্থাগার সমৃদ্ধ করা, পেশাজীবী, পেশাদার, সৌখিন শিল্পী, শিল্পকলার বিচারক এবং শিল্পকর্ম ও শিল্পে ব্যবহার্য উপকরণাদির বিক্রির জন্য বাজারের সৃষ্টি হয়।৩০ শিল্পকর্মের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ব্যাপকভাবে ক্যালিগ্রাফি তৈরি শুরু হয়। সহজ মাধ্যম হিসেবে কাগজে, প্যাপিরাসে শিল্পীরা ক্যালিগ্রাফি করতে থাকেন। ধীরে ধীরে ঝিল্ল¬ী ও চামড়ার ব্যবহার উঠে যায়। আব্বাসীয় যুগের (৭৫১-১২৫৮ খৃ.) প্রথমদিকেই পবিত্র কুরআনের জন্য কয়েকটি লিপি যেমন- নাসখী, রিকা, সুলুস, রায়হানী, মুহাক্কাক প্রভৃতি নির্দিষ্ট হয়ে যায়। অনুরূপভাবে কুরআন বহির্ভূত বিভিন্ন বিষয়ের জন্য পৃথক পৃথক স্টাইলের লিপির ব্যবহারও প্রায় নির্দিষ্ট হয়ে যায়। বস্তুত বই-পুস্তক লেখার জন্য অধিকতর সুস্পষ্ট ও সহজ পঠনযোগ্য, বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোন থেকে মুক্ত ও সাংস্কৃতিক বিকাশের দাবি পূরণকারী এসব লিপির উদ্ভাবন ছিল অপরিহার্য। সহজ লিখনযোগ্য ও বিশেষ ব্যবহারের লক্ষ্যে উদ্ভাবিত এসব লিপি আলাদা আলাদাভাবে সরকারী দলিল-দস্তাবেজ, চিঠিপত্র, কেনাকাটার তালিকা, শ্রবণ থেকে অনুলিখন, এমনকি কবুতরের মাধ্যমে প্রেরণের চিঠির জন্য লেখা হতো। আব্বাসীয় আমলেই বাগদাদ ক্যালিগ্রাফি উৎপাদনের কারখানা স্বরূপ গড়ে উঠে। বাগদাদের এসময়কার ক্যালিগ্রাফি শিল্পের শৈল্পিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ সম্পর্কে ইয়াসির তাব্বা একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। সত্যিকার চারুকলার বিষয় হিসেবে ক্যালিগ্রাফিকে (ক্লাসিক অর্থে) সুসংহত করেন রাজনীতিবিদ, কবি ও ক্যালিগ্রাফি শিল্পী আবু আলী ইবনে মুকলা (মৃ. ৯৪০খৃ.) এবং তার ভাই ও ক্যালিগ্রাফি শিল্পী আবু আব্দুল্লাহ ইবনে মুকলা (মৃ. ৯৪৯ খৃ.)। তারা দু’ভাই ক্যালিগ্রাফিকে আনুপাতিক লেখনীতে বিন্যস্ত এবং একে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেন। যেটা ক্যালিগ্রাফির শিল্পমানকে উত্তরোত্তর শাণিত করে। ইবনে মুকলার ছাত্র আলী ইবনে হিলাল ইবনে বাওয়াব (মৃ. ১০২২ খৃ.) হচ্ছেন ইসলামের ইতিহাসে দর্শনীয় শিল্পকর্মের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী। একাধারে অভ্যন্তরীণ চিত্রকর (Interior Painter) ও ক্যালিগ্রাফির প্রতি অত্যন্ত একনিষ্ঠ হওয়ায় ইবনে বাওয়াব এ শিল্পকে শিল্পকলার শীর্ষে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। এছাড়া ইয়াকুত আল মুস্তাসিমী (মৃ. ১২৯৮ খৃ.) ক্যালিগ্রাফির ট্রেডিশনাল ধারাকে সঠিক মাপে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং ভবিষ্যত শিল্পকলায় লিভিং আর্ট হিসেবে একে স্থাপন করেন।যুগের পরিক্রমায় ইসলামী ক্যালিগ্রাফি পশ্চিমে মাগরিব বা মরক্কো থেকে পূর্বে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত একটি প্রভাব বিস্তারকারী শিল্পধারা হিসেবে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখে। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে বিস্তার লাভের পর এতে নানামুখী স্টাইল ও ধারা যেমন জন্মলাভ করে তেমনি সাংস্কৃতিক বিকাশে স্থানীয় উপায়-উপকরণকে আত্মস্থের মাধ্যমে এটি বিস্ময়কর শিল্পে রূপলাভ করে। এ শিল্পের সংস্কার সাধনে প্রায় প্রতি শতাব্দীতে প্রয়াস চালাতে হয়েছে। ১৩৮০ খ্রীস্টাব্দে আনাতোলিয়ার বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফির ওস্তাদ ও শিল্পী সেইহ্ হামদুল্ল¬াহ ক্যালিগ্রাফির পূর্ণাঙ্গ সংস্কার সাধনে ব্রতী হন এবং মাত্র দুই বছরে তিনি এর যাবতীয় খুঁটিনাটি বিন্যস্ত করেন এবং সাফল্যের সাথে একে পূর্ণতা দান করেন।
পাশ্চাত্য পেইন্টিংয়ের সাথে সমানতালে ক্যালিগ্রাফি তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। এতে শুধু আরবরাই নয় বরং সমগ্র মুসলিম জাহাানের শিল্পীরা অবদান রেখেছেন। উনবিংশ শতাব্দীতে বিস্ময়কর সব ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম একে স্থায়ী মানদণ্ডে উপস্থাপন করে। এ সম্পর্কে তুর্কী গবেষক ও বিশেষজ্ঞ মাহমুদ ইয়াযীর অত্যন্ত চমৎকার মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, “মুসলিম সম্প্রদায়ের ভেতর শুধু আরবরাই নয়। বরং তুর্কী, মিশরীয়, সিসিলীয়, তিউনেসীয়, আলজেরীয়, মরক্কান, আন্দালুসীয়, সুদানীয়, ইরানী, আফগান, মধ্য এশীয়, ভারতীয়, দক্ষিণ-পূর্ব ভারতীয়, জাভানীজ, লায, কুর্দি, বুলগেরিয় পোমাক মুসলমান, বসনীয়, আলবেনীয় এবং সের্কাসীয় নির্বিশেষে সকল মুসলিম জাতির লোকেরাই ক্যালিগ্রাফির অত্যাশ্চর্য শিল্পকর্ম তৈরি করেছেন। এসব জাতি ছাড়া আরো বহু জাতির মধ্যে অনেক মহান ডিজাইন শিল্পী, পেইন্টার, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, দার্শনিক, কবি, সাহিত্যিক, বাদক, গায়ক, চিকিৎসক, ধর্মতাত্ত্বিক, পীর-মাশায়েখ, মুফতি, বিচারক, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, মন্ত্রী, পাশা, পরামর্শক, জেনারেল, শাহ ও সম্রাটের উদ্ভব ঘটে, যারা তাঁদের ক্যালিগ্রাফির মাস্টার পিসের জন্য গোটা জীবন ব্যয় করেছেন এবং দৃষ্টিশক্তি ধ্বংস করেছেন এবং বলা যায় ওসমানীয় খেলাফতের পতন যুগেও ক্যালিগ্রাফির বিস্ময়কর অগ্রগতির নেতৃত্ব দিয়েছেন তুরস্ক, বিশেষ করে ইস্তাম্বুল নগরীর মহান শিল্পীরা।”
একবিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য শিল্প যখন ডিজিটাল মাধ্যমে আত্মস্থ হওয়ার প্রয়াস চালাচ্ছে, ক্যালিগ্রাফির ট্রেডিশনাল ও পেইন্টিং উভয় মাধ্যম তখন অনায়াসে স্বকীয়তা বজায় রেখে তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে এবং প্রযুুক্তির সর্বাধুনিক মাধ্যমকেও ক্যালিগ্রাফিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। গ্রাফিক্স আর ডিজিটাল সাপোর্ট সাম্প্রতিক ক্যালিগ্রাফিতে ত্রিমাত্রিক ধারণাকে বাস্তবের অনুভূতি এনে দিয়েছে। ক্যালিগ্রাফির জ্যামিতিক ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ভারসাম্যের আঙ্গিকগত দিকটি বর্তমান সময়ের তথ্য প্রযুক্তির মাধমে সহজভাবে আমরা অনুভব করতে পারছি। যুক্তরাজ্যের আহমদ মুস্তফা, যুক্তরাষ্ট্রের মামুন শাক্কাল ও মুহাম্মদ জাকারিয়া, জাপানের ফুয়াদ কৌচি হোন্ডা যেমন আধুনিক শিল্পকলায় ইসলামী ক্যালিগ্রাফিকে পেইন্টিং ও ট্রেডিশনাল ধারায় শীর্ষে স্থাপনের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে ট্রেডিশনাল ধারায় একে বিশুদ্ধ ঐতিহ্য রক্ষার বিষয়টি সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন একবিংশ শতাব্দীর মাস্টার ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরা। যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তুরস্কের হাচান চালাবি এবং ইরানের আমীর খানির মত ওস্তাদ ক্যালিগ্রাফাররা। ক্যালিগ্রাফির ঐতিহ্যিক ব্যবহার ছাড়িয়ে একে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সৌন্দর্যের প্রতি অতি আগ্রহী শিল্পীরা। মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে বহু পাশ্চাত্যবাদী শিল্পী ক্যালিগ্রাফিকে উল্কি মাধ্যম, হেয়ার স্টাইল ও ফিগারেটিভ পেইন্টিংয়ে ব্যবহার করছেন। ফিগারেটিভ পেইন্টিং ছাড়াও জুমরফিক, এনথ্রোপগ্রাফি প্রভৃতি জীব আকৃতির ক্যালিগ্রাফিকে ’ক্যালিগ্রাম’ বলে চালানো হচ্ছে। পয়েন্টালিজমেরর মত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ক্যালিগ্রাফিক হরফ ব্যবহার করে নির্বস্তক, অর্ধ নির্বস্তক এমনকি ফিগার আঁকা হচ্ছে। একে ইতিবাচক বা নেতিবাচক যাই বলি না কেন ইসলামী ক্যালিগ্রাফিকে একটি শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম বা শিল্পের ভাষা হিসেবে আধুনিক শিল্পীরা ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। বাংলাদেশের ছাপচিত্র শিল্পীদের অন্যতম কালিদাস কর্মকার তার পেইন্টিংয়ে দক্ষতার সাথে ইসলামী ক্যালিগ্রাফির মোটিফ ও বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্মের অংশ বিশেষ সফলভাবে ব্যবহার করছেন। আরেক স্পেন প্রবাসী ছাপচিত্রী মনিরুল ইসলামও ক্যালিগ্রাফিকে তার পেইন্টিংয়ের অনুসঙ্গ করেছেন। মুর্তজা বশীরের কালিমা তৈয়্যবা প্রদর্শনীতে যে পেইন্টিং ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম আমরা দেখেছি বাংলাদেশের পেইন্টিং ধারায় সেটা একটি বড় ধরনের পাশ ফেরা বলা যায়। এছাড়াও সাইফুল ইসলাাম, ইব্রাহিম মন্ডল, আরিফুর রহমানসহ শতাধিক নবীন প্রবীণ শিল্পী ক্যালিগ্রাফি চর্চায় নিমগ্ন হয়েছেন। এক্ষেত্রে ঢাকা সাহিত্য সাংস্কৃতি কেন্দ্র ও ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি বাংলাদেশের আয়োজিত ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীসমূহ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্যালিগ্রাফিকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। ক্যালিগ্রাফি শেখার ব্যবস্থা হয়েছে, সহায়ক বই পত্র প্রকাশিত হয়েছে এবং নিয়মিত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীসমূহে ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরা অংশ নিচ্ছেন।
সাম্প্রতিক বিশ্বব্যাপী ক্যালিগ্রাফিতে একটি প্রবল প্রবাহ আমরা প্রত্যক্ষ করছি। ইন্টারনেট ব্যবহারের সহজলভ্যতা আমাদেরকে এ বিষয়ের প্রতিটি কর্মচাঞ্চল্য সম্পর্কে অবহিত করছে। প্রায় প্রতিদিনই বিশ্বের কোথাও না কোথাও ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী, ওয়ার্কশপ, ক্রাফট ফেয়ার ,সেমিনার, প্রতিযোগিতা প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
সংস্কৃতি বিকাশে ইসলামী ক্যালিগ্রাফির এই অনায়াস বাস্তবতাকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। আমাদেরকে ক্যালিগ্রাফির মোহনীয় সৌন্দর্য যেমন আবিষ্ট করে, তেমনি সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে বিবেচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করি।
টিকা ও তথ্যসুত্র ঃ
১. Marshall Klarfeld, independent researcher and author of Adam: The Missing link, www.dailynexus.com/article/php% 3.... (Author Discusses a New History of Human Creation By Matt Cappoello, Staff writer, Published Monday November 21,2005, Issue 44/ Volume 86)
২. A timeline of Israel in Context with world Events Part I (Edited and amended by Jonathan Hirshon, Original Varsion by Dr. Shirley J. Rolllinson). (Internet, google Search).
৩. প্রাগুক্ত
৪. Sons of Noah. (Semitic, Internet, google search, http://en.wikipedia. org/wiki/semitic)
৫.Brief History of the Traditional Arabic Type. (1.1 The origin of the Arabic Script., Internet, google search.)
৬. প্রাগুক্ত
৭. The Cultural Atlas of Islam. by Ismail R. Al Faruqi and Lois Lamya Al Faruqi, Macmillan publishing Company. New York. 1986, pp-20-42
৮. পবিত্র কুরআন. (সূরা - ১৬ : আয়াত - ১০৩, ২৬ : ১৯৫, ১২ : ২, ১৩ : ৩৭, ২০ : ১১৩, ৩৯ : ২৮, ৪১ : ৩, ৪২ : ৭, ৪৩ : ৩, ৪৬ : ১২)।
৯. মধ্যযুগের ইউরোপ ও সমস্ত এশীয়কে শামের বংশধর (সেমেটিক) ধরা হত। কিন্তু ১৯ শতকে সেমেটিক শব্দটি ঐতিহাসিকভাবে সেমেটিক ভাষাভাষীদের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত নিকট প্রাচ্যের জনগোষ্ঠী যেমন- আরব, সিরিয়ান ও ইহুদীদেরকে সেমেটিকরূপে চিহ্নিত করা হয়। (Internet, Google search, http://en.wikipedia.org/wiki/semitic)
১০. প্রাগুক্ত
১১. The Graphic Arts. Marshall Cavendish Book limited, 58 old Comption street, London, WI, 1970. P-5
১২. Qadi Ahmad, Gulistan-i-Hunr, Eng. Trans. entitled, Calligraphers and Painters, T. Minorsky (Washington: Freer Gallery of Art, 1959) P-52..
১৩. Al. Qasd Wa Al-Umam, P-17
১৪. Abul Fadl `Allami, Ain-i-Akbari. Vol. I tr. H. Blochmann (Calcutta : Asiatic Society of Bengal. 1873) P-99
১৫. কিবতী - প্রাচীন মিশরের কপটিক খ্রীস্টান সম্প্রদায়,(Dubai International Exhibition of The Arabic Calligraphy Art. The Arabic Calligraphy ... record of a nation by Muhammad Abdu Rabah U' lan. P-49)
১৬. তিন লাইনের এই প্রস্তর ফলকের প্রথম ছত্রে লেখা আছে।এক. দানাহ নাফসু ফিহরু অর্থাৎ এটা একটা ফিহরের সমাধি,দুই. বিরসলি রবউ যাজিমাহ অর্থাৎ জাজিমাহ মুরবিব রসলিরতিন. মালিক তানুখ অর্থাৎ মালিক তানুখ উপাধি ধারী সালি মুরবিব জাজিমার পুত্র ফিহর।জর্ডানের হাওরান নামক স্থানের দক্ষিণে এই সমাধিফলকটি পাওয়া যায়। (কামিল সালমান আল জাবুরী, মুসেআহ আল খত আল আরাবি, আল খত আল কুফী, দারু মাকতাবাহ আল হিলাল, বইরুত, লেবানন, ১৯৯৯, পৃ-৩১)
১৭. প্রাগুক্ত. পৃ-৩২
১৮. প্রাগুক্ত. পৃ-৩৩
১৯. প্রাগুক্ত. পৃ-৩৫
২০. Arabic Alphabet, Pronunciation and language, (http : // www.omniglot.com/writing/arabic.htm)
২১. রাসূল (সাঃ) বাহরাইনের শাসক মুনযির বিন সাবির নিকট ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত একটি পত্র প্রেরণ করেন। পত্রটির বাহক ছিলেন সাহাবী আলা বিন হাদরামী। পত্রের নীচে রাসূলের মোহরের ছাপ রয়েছে। উলে¬খ্য, রাসূলের নির্দেশে এই স্টাইলে মোহর খোদাইকারী মোহরটি তৈরী করেন। কুফি মাসক লিপি, কোন কোন গবেষক প্রাচীন নাশখী লিপি বলেছেন এই মোহরের লিপিকে।(Dubai International Exhibition (4th Session 2007) Arabic Calligraphy Art. P-53)
২২. এদেরকে ওহির লেখক বলা হয়। এরা হলেন, ১. আসআদ বিন যারারাহ, ২. আবু আবস বিন জাবর, ৩. উসাইদ বিন হুদাইর, ৪. আওস বিন খাওলি, ৫. বাশির বিন সাদ, ৬. জাহিম বিন সালত, ৭. রাফে বিন মালেক, ৮, যায়েদ বিন আরকাম, ৯. যায়েদ বিন সাবিত, ১০. সাদ বিন রবি’, ১৪. আবদুল্ল¬াহ বিন আমর ইবনুল আস, ১৫. মাআন বিন আদি। এছাড়া আরো অনেকে কুরআনের লেখক ছিলেন। রাসূল (সাঃ)-এর এই কাতেবদের সংখ্যা ৪২ জনে উন্নীত হয়েছিল। যাদের মধ্যে উল্লে¬খযোগ্য হচ্ছেন, উবাই ইবনে কাব। (আহমদ সাবরি যায়েদ, তারিখ আল খত আল আরাবী ওয়া আ’ল্লাম আল খাত্তাতীন, দার আল ফাদিলাহ, কায়রো, মিশর ১৯৯৯ পৃ-১১-৩৭)
২৩. তফসীর মাআরেফুল কুরআন (পবিত্র কুরআনুল করীম, হযরত মওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী (রহঃ) অনুবাদ ও সম্পাদনা : মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, খাদেমুল হারামইন বাদশাহ ফাহাদ কুরআন প্রকল্প, মদীনা মোনাওয়ারা, ১৪১৩ হিঃ পৃ-১৫৮) সূরা-২ আয়াত-২৮২।
২৪. এটা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পূর্ব থেকে লেখা তাওরাতের পাতা বা তখতী হযরত মূসা (আঃ) কে অর্পণ করা হয়েছিল। আর সে তখতীগুলোর নামই হলো ‘তওরাত’। সূরা-৭, আয়াত-১৪৫, প্রাগুক্ত, পৃ-৪৮২। এছাড়া সূরা-২ আয়াত - ১০৫ বলা হয়েছে, আমি উপদেশের পর যাবুরে লিখে দিয়েছি যে, আমার সৎকর্ম পরায়ণ বান্দাগণ অবশেষে পৃথিবীর অধিকারী হবে। এ আয়াতের মাধ্যমেও বুঝা যায় যাবুর লিখিত ছিল। প্রাগুক্ত পৃ- ৮৯১-৮৯২।
২৫. সালমান আল জাবুরী, প্রাগুক্ত পৃ-২০, রওয়াহু আল তিবরানী ফি আল কাবীর ওয়া গয়রাহ।
২৬. প্রাগুক্ত, পৃ-২০, রওয়াহু ইবনে নাজ্জার।
২৭. প্রাগুক্ত পৃ-২০, রওয়াহু আল দায়লামী ফি মুসনাদ আল ফিরদাউস।
২৮. Histry of Islamic Calligraphy. by m Zaqani, Mahjubah. January 2006, Iran.
২৯. Arabic Calligraphy in Manuscripts. King Faisal Centre Research and Islamic Studies PP-30-50
৩০. M. Zaquani- প্রাগুক্ত
- মোহাম্মদ আবদুর রহীম : গবেষক, শিল্পী, গ্রন্থকার ও সেক্রেটারি, ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি বাংলাদেশ, প্রশিক্ষক, ক্যালিগ্রাফির শৈলী বিষয়ক কোর্স।
খুবই তথ্য সমৃদ্ধ ও গবেষণাধর্মী লেখা। বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উন্নতিতে এ লেখা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি। অসংখ্য ধন্যবাদ লেখককে।
ReplyDelete