Tuesday, June 2, 2015

calligraphy of kaaba কাবা শরীফের ক্যালিগ্রাফি




-মোহাম্মদ আবদুর রহীম
হজ্জ-ওমরা পালনে পবিত্র মসজিদুল হারামের প্রাঙ্গনে পৌঁছে হাজীগণের হৃদয় জুড়িয়ে যায় কালো গিলাফে আবৃত কাবা শরীফ অবলোকন করে। এক অপার্থিব ভালো লাগা জড়িয়ে ধরে গিলাফে উৎকীর্ণ সোনার সুতোয় বোনা ক্যালিগ্রাফি দেখে। কাবার ভেতরে-বাইরে এই অত্যাশ্চর্য ক্যালিগ্রাফির প্রতি মানুষের আকর্ষণ অপরিসীম ও চিরন্তন।
গত ফেব্রুয়ারি২০১৫ আল্লাহর অসীম করুণা ও রহমতে পবিত্র কাবা জিয়ারত ও ওমরা পালনের সৌভাগ্য হয়েছিল। প্রায় সপ্তাহ খানেক মক্কায় অবস্থানকালে আশ-পাশের দর্শনীয় স্থান দেখার সুযোগ হয়েছে। একজন ক্যালিগ্রাফার হিসেবে পবিত্র দুই মসজিদের স্থাপত্য নিদর্শনের মহামূল্যবান প্রদর্শনি দেখতে পেরে আনন্দ ও জ্ঞান লাভ করেছি। ঐ প্রদর্শনিতে কাবা ঘরের শত শত বছরের প্রাচীন ক্যালিগ্রাফির অংশবিশেষ ছিল। গিলাফ-দরোজা-দেয়াল-মিহরাব-মিম্বর-থাম ইত্যাদি প্রত্যেক স্থানের আরবি ক্যালিগ্রাফির অসাধারণ নিদর্শনের সংরক্ষিত অংশ প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। আরও ছিল হাতে লেখা কয়েকশ বছরের প্রাচীন কুরআন।  কপিকলসহ জমজম কূপের উপরের অংশ, মাকামে ইব্রাহীমের ভেতর পাথরের ওপর পায়ের ছাপের আদলে রূপার আচ্ছাদন ও বাইরের ঘর, হজরে আসওয়াদের ওপরের পেতলের এবং রূপার আচ্ছাদন, গিলাফ বোনার হাতে চালানো তাত, পাথরের পিলার, প্রায় হাজার বছরের পুরনো কাঠের স্তম্ভ,  কাবার মূল খুটি হিসেবে যেটার ব্যবহার হয়েছিল।
রাসূলের সা. সময় কাবার গিলাফে ক্যালিগ্রাফির কথা জানা যায় না। তবে ৪০ হিজরী মক্কা ও তায়েফে প্রাপ্ত উৎকীর্ণলিপি থেকে জানা যায়, আরবি ক্যালিগ্রাফির তখন বেশ উন্নত স্টাইল প্রচলন ছিল। সৌদি আরবের উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উস্তাদ ড. নাসের বিন আলী আল-হারেসী এক গবেষণায় এ তথ্য জানান।
কাবার গিলাফে আরবি ক্যালিগ্রাফির নান্দনিক উপস্থাপনের বিষয়ে রিয়াদের ইমাম বিন সউদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শরিয়া কলেজের উস্তাদ ড. মুহাম্মদ বিন হুসাইন আল-মাওজান বলেন, ইতিহাসের তথ্য-উপাত্ত মতে, মিশরের মামলুক সুলতানদের আমলে কাবার ভেতর ও বাইরে আলাদাভাবে গিলাফ আবৃত করা হত এবং তাতে আরবি ক্যালিগ্রাফি দিয়ে অলঙ্কৃত করা হত। মামলুক আমলের ৭৬১ হিজরিতে সুলতান নাসের হাসান বিন মুহাম্মদ বিন কালাউনের সময় কাবার ভেতরের গিলাফের একখন্ড এখনও সংরক্ষিত আছে। তবে কাবার গিলাফের ভেতর-বাইরে উভয় অংশে শৈল্পিক এবং নয়নাভিরাম ক্যালিগ্রাফির অলঙ্করণ শুরু করেন তুর্কী ওসমানীয় সুলতানগণ। তাদের সময়ে ক্যালিগ্রাফির সবচেয়ে নান্দনিক শৈলি সুলুস ও জালি সুলুসের ব্যাবহার শুরু হয়। মামলুক সুলতানদের সময়ে রায়হানী ও মুহাক্কাক শৈলীর কায়রো ধারায় ক্যালিগ্রাফি ব্যবহৃত হত। তবে কাবার চারপাশে মসজিদে হারামে কুফি কাইরোয়ানী, জাহরি-নাবতি লিপির অলঙ্করণ ছিল।
 সৌদি বাদশাহ আবদুল আযীয আল সউদ ১৩৪৬ হিজরিতে গিলাফ বা কিসওয়া তৈরির একটি বিশেষ কারখানা নির্মাণের নির্দেশ দেন এবং সে বছরেই অত্যন্ত মনমুগ্ধকর ক্যালিগ্রাফি সজ্জিত গিলাফ তৈরি করে কাবা ঘর আবৃত করা হয়। ক্যালিগ্রাফির শৈলি নির্ধারণের জন্য বিশ্বের নামকরা ক্যালিগ্রাফারদের এক সম্মেলন আহবান করা হয়, সেখানে সুলুস লিপিকেই সর্বসম্মত রায় দেয়া হয়। বর্তমানে গিলাফের খ্যাতনামা ক্যালিগ্রাফার মুখতার শোকদার (বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত) এ তথ্য জানান।
কাবার গিলাফের বাইরের কালো কাপড়ে স্বর্ণমণ্ডিত রেশমি সুতা দিয়ে দক্ষ কারিগর দিয়ে ক্যালিগ্রাফি করা হয়। মুখতার শোকদার বলেন, ঝারনিখ কালি দিয়ে প্রথমে কাপড়ে ক্যালিগ্রাফির আউট-লাইন দেয়া হয়, তারপর কারিগরগণ হরফের ভেতর রেশমি সুতার মোটা লাইন বসিয়ে স্বর্ণের সুতা দিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে হরফ ফুটিয়ে তোলেন। গিলাফের কালো জমিনে স্বর্ণের সুতার ঢেউ খেলানো বুননের ক্যালিগ্রাফির সোনালি আভা এক জান্নাতি আবেশ ছড়িয়ে দেয়।
বাদশাহ ফাহদ বিন আবদুল আযিযের সময় থেকে গিলাফের প্রধান ক্যালিগ্রাফার হিসেবে সৌদি বংশোদ্ভুত আবদুর রহীম আমিন বুখারী দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ক্যালিগ্রাফি হিসাবে কুরআনের আয়াত, আল্লাহর গুনবাচক নাম বিশেষ নকশা আকারে উপস্থাপন করা হয়। হজরে আসওয়াদের উপর অংশে আল্লাহ আকবর ক্যালিগ্রাফিসহ বর্তমানে গিলাফের অধিকাংশ ক্যালিগ্রাফি মুখতার শোকদারের হস্তলিখিত। কাবার ভেতরের অংশের গিলাফে তিরাজ নামে তেরছা ধরণের বিশেষ বুনন ও কালেমা ক্যালিগ্রাফি করা হয়।
কাবার স্বর্ণমন্ডিত ধাতব দরোজার ওপর সুলুস লিপিতে ক্যালিগ্রাফি বিদ্যমান। কাবার স্থাপত্য প্রদর্শনিতে প্রাচীন কাঠের নকশা করা দরোজায় মুহাক্কাক লিপিতে ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে গিলাফে এবং দরোজার ক্যালিগ্রাফিতে বিভিন্ন আয়াত দিয়ে অলঙ্কৃত করা হয়েছে। দরোজার তালা ও চাবি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আকৃতি এবং গঠনের, এতে সুক্ষ্মভাবে ক্যালিগ্রাফি উৎকীর্ণ দেখা যায়। এমন কি কাবা ঘরের ছাদের  ধাতব চৌকোনা আকারের পানি নিঃসরন নলটির দুই পাশে সুলুস লিপিতে কুরআনের আয়াত উৎকীর্ণ করা হয়েছে। এ নলটিও নির্দিষ্ট সময় পর পর পরিবর্তন করা হয়েছে বলে পুরাতন কয়েকটি প্রদর্শনিতে  দেখা যায়।
কাবা ঘরের ভেতর চার দেয়ালে বিভিন্ন ধরণের পাথরের পাতে সুরা ও কালিমা ক্যালিগ্রাফি উৎকীর্ণ আছে। এসব ক্যালিগ্রাফিতে মুহাক্কাক, রায়হানী, সুলুস, কুফি শৈলীর ব্যবহার দেখা যায়। কাবার দরোজা দিয়ে ঢুকে হাতের ডানপাশে হাতিমের দিকের দেয়ালের ডানপাশে বাব আত-তাওবা নামে একটি দরোজা আছে। এটি ধাতব নির্মিত এবং স্বর্ণ মণ্ডিত, এতে কুরআনের আয়াত ও আল্লাহর নাম দিয়ে সুলুস লিপিতে ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে। বাদশাহ খালিদ বিন আবদুল আযিযের নির্দেশে এতে স্বর্ণ দ্বারা প্রলেপ দেয়া হয়।
পবিত্র কাবা ঘরে কুরআনের আয়াতের ক্যালিগ্রাফি দিয়ে সুশোভিত করার মাধ্যমে ইসলামের আধ্যাত্মিক শিল্পকলার যাত্রা শুরু হয়। মানুষ আল্লাহ তায়ালাকে চর্ম চোখে দেখতে পায়না কিন্তু আল্লাহর বানীর এই নান্দনিক শৈলী অবলোকন করে হৃদয়ে তাকে অনুভব করে। এই বোধ মানুষকে উত্তরোত্তর স্রষ্টায় সমর্পিত ও নিবেদিত হতে প্রেরণা যোগায়।##