-ভাই, কেমন যাচ্ছে শরীরটা?
-আল্লাহর মেহেরবাণীতে ভালো, আপনার বইয়ের ছাপার কদ্দূর হলো?
-ইনশাআল্লাহ, কয়েকদিনের মধ্যেই ছাপা হয়ে যাবে।
-এ মাসের মধ্যে হবে তো! এককাজ করেন, প্রুফ কপিটাই দেন একটু পড়ি।
এরকম কথা-বার্তা প্রায়ই হতো তার সাথে।ফজরের নামাজ মসজিদে পড়ে রমনা পার্কে
যেতে তার যেমন আগ্রহ ছিল, তেমনি ছিল ক্যালিগ্রাফি নিয়ে। বলা যায়, তার
সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে এই শিল্পময়তা ছিল পরিপূর্ণ। দিন-দিন শরীরটা তার দ্রুত
যেন শুকিয়ে যাচ্ছিল। মাঝে-মধ্যে চেপে ধরলে সযতনে এড়িয়ে যেতেন। প্রবল
উচ্ছাস নিয়ে কথা হতো, কিন্তু দৈন্যতার কথা কখনও শুনিনি। আশ্চর্য
আত্নসম্মানবোধ ছিল। তাকে কখন যে শ্রদ্ধায় হৃদয়ে ধারণ করেছি, তা জানিনা।
তিনি বন্ধু ছিলেন, মৃদু হাসি দিয়ে সব সময় আহবান করতেন।
প্রতিদিন শিল্পকোণে(আমাদের সকালের আড্ডাখানা) একবার ঢু দিয়ে তারপর কাজে
বেরিয়ে পড়তাম। এখন হু হু করে ওঠে ভেতরটা। ঠিক বোঝানো যায়না বিষয়টা।
শিল্পকোণে তাকে না পেলে আসাদ ভাইয়ের ডেরায় হয়তো পেযে যেতাম। শিল্পকোণ আর
প্রীতিপ্রকাশন মোটামুটি এদু'জায়গায় তার সাথে কথা হত বেশি। কার্টুনিস্ট
ইমন্ডল ভাইয়ের অফিসেও তার সাথে জমিয়ে আলাপ হতো। আর বুকপকেটে প্রিয়তমার
চিঠির মত দু'একটা কবিতা তার সবসময়ই থাকত। একফাকে গভীর আবেগে তা আমাদের
পড়ে শুনাতেন। তার কবিতা যেন মধুমতির দুলে ওঠা গীতল ঢেউ। নদীর পাড়ে
হিজলবনে পাখির করুণ কুজনের মত তার দূরগামী আহবান আমাদেরকে আপ্লুত করত। নদী
তীরের বালুকাবেলায় বুনোঘাস আর কাশফুলের মিতালি তার কবিতায় মূর্ত হয়ে
উঠত। মুহুর্তে হারিয়ে যেতাম বালকবেলায়। শৈশব যেন তার কবিতায় ঝলমল করে
উঠত। সোঁদামাটির ঘ্রাণ ছিল কবিতার পরতে পরতে। কী অদ্ভুত গীতল তার
কবিতাগুলো।
কখনও ফুটপাত ধরে উদ্দেশ্যহীন হেটে যেতাম দুজনে। জীবনের আক্ষেপগুলো পাশ
কাটিয়ে শিল্পের কী লেখা হলো না, তাই নিয়ে হা হুতাশ হতো। আরো কত কথা।
সন্ধ্যার পর রেললাইনে দাড়িয়ে চাঁদনি গায়ে মাখতে মাখতে কখনও গালিবের মত
দরাজ গলায় হঠাত গেয়ে উঠতেন।
ক্যালিগ্রাফির প্রতি তার আগ্রহ আর ভালবাসা আমাদেরকে নাড়িয়ে দিত। প্রতি
মাসের দশ তারিখ সন্ধ্যায় বাংলা সাহিত্য পরিষদের সভায় বলা যায়, তার
আকর্ষণেই ছুটে যেতাম। লেখা পাঠ শেষে তার সংক্ষিপ্ত অথচ যথাযথ
দিকনির্দেশনায় বুক ভরে যেত। সেই প্রেরণায় কত যে ক্যালিগ্রাফি বিষয়ক লেখা
তৈরি করেছি। তিনি বাশের কলম দিয়ে ক্যালিগ্রাফির হরফ লিখতেন আর ডেকে
দেখাতেন, তার আফসোস দেখে আমরা হাসতাম, মজা পেতাম। বলতেন, হরফগুলোকে যেন বশ
মানানো যাচ্ছে না। অথচ তার বাংলা হরফ ছিল কিংবদন্তির মত।
প্রতিবছর ক্যালিগ্রাফির প্রদর্শনীর আগে বলতেন এবার ত হলোনা, আগামীবার অন্তত
একটা ক্যালিগ্রাফি করেই ফেলবেন। অনেক খশড়া করতেন আর বলতেন, দেখবেন একদিন
সেরা একটা ক্যালিগ্রাফি করে ফেলেছি। তার উচ্ছাস আমাদেরকে মুগ্ধ করত।
একদিন চিরকুট দিয়ে পাঠালেন, ক্যালিগ্রাফির কিছু বইপত্র আর আর্টিকেল দরকার
তার। তার জন্য সেগুলো জোগাড় করছি, কিন্তু তা আর দেয়া গেল না, তিনি সব
কিছুর উর্ধে চলে গেলেন এক ভোরে। এখনও বুক পকেটে কোন কাগজের টুকরো দেখে হু
হু করে ওঠে ভেতরটা।
রাতদিন খেটেখুটে ম্যাটার তৈরি করছি। প্রথম বই। যেন প্রথম সন্তান। প্রচন্ড খাটুনি। তবু আনন্দ হচ্ছে, তাকে চমকে দেব।
-এই নেন, আপনার জন্য এ বান্দার পক্ষ থেকে সামান্য উপহার।
কিন্তু কে জানত! সেই বইয়ের ভেতরই আমাকে লিখতে হবে "মরহুম কবি গোলাম মোহাম্মদ, মৃত্যু ২২ আগস্ট ২০০২"।
তার ভেতরটা ছিল শিল্পরসের খর্জুরবৃক্ষ। ক্যালিগ্রাফির প্রতি তার অফুরান
ভালবাসা ছিল মধুমতির মত দরাজদিল। তিনি ছিলেন আমাদের প্রেরণার বাতিঘর।
###