শিল্পকলা মানব ইতিহাসের মতই প্রাচীন বিষয়। মানুষ তার জৈবিক চাহিদা পূরণ আর মানসিক প্রশান্তি খুঁজতে নানা কর্মকান্ডে আত্মনিয়োগ করেছে। জৈবিক প্রয়োজনে খাদ্য সংগ্রহ, বংশ বৃদ্ধি, কৃষিকাজ, শিকার কৌশল রপ্ত, পশু পালন, বাসস্থান নির্মাণ যেমন করেছে, কাজের অবসরে আনন্দ-ফূর্তির সাথে মানসিক প্রশান্তির জন্য কিছু একটা করার অনুভূতি তাকে আকুল করেছে। আত্মার এই আকুতি কখনো তাকে মহাশক্তির প্রতি লুটিয়ে পড়তে আবার কখনও অবাধ্য হতে প্রলুব্ধ করেছে।
শিল্পকলা তাই ধর্মাশ্রয়ী হয়ে টিকে থেকেছে অধিকাংশ সময়। এটা কখনো নিরপে ছিল না এবং এখনো নেই। সব শিল্পদর্শনের পেছনে শক্তিশালী হাতের ছায়া প্রত্যভাবে গোচরে না এলেও গবেষণায় তা প্রতিভাত হয়েছে।
শিল্পকলা সভ্যতার পরিচয় তুলে ধরে। কোন জাতির মানসিক অবস্থা জানতে বা পরিবর্তন করতে প্রাচীনকাল থেকে শিল্পকলা মোম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক রাজনীতি ( Psyco-politics)- এর ইতিহাসে যারা বিশেষজ্ঞ, তাদের কাছে, শিল্পকলার প্রধান দুটো দিক স্বর্গীয় আর্ট ( Divine Art) এবং উত্তেজক আর্ট ( Sensate Art) কিভাবে সভ্যতার পরতে পরতে উত্থান-পতনে ভূমিকা রেখেছে, তা পরিজ্ঞাত।
উত্তেজক আর্ট হচ্ছে শুধুমাত্র স্থুল চিন্তা-ভাবনা নির্ভর। যেভাবেই তা প্রকাশ করা হোক না কেন, মানুষের মধ্যে সেটা নীচ উপকরণ নিয়ে আলোচনা করে এবং অশ্লীলতার প্রসার ঘটায়। সভ্যতার আভ্যন্তরিন মানসিকতায় একটা অলঙ্ঘনীয় নীচতাকে প্রকট করে তোলে। এর হিরোরা সাধারণত দেহপশারিনী অথবা সংশ্লিষ্ট মানসিকতায় আবদ্ধ, দু®কৃতিকারী, ভণ্ড, প্রতারক এবং দুরাত্মা লোকেরা। ইন্দ্রিয় ভোগ-সম্ভোগের চেষ্টা করা, আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত রাখা, শ্রান্ত স্নায়ুমণ্ডলিকে উত্তেজিত করা, স্থুল আনন্দ-স্ফূর্তি, জৈবিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য পরিবেশন, অনৈতিকভাবে ব্যক্তিস্বার্থ আদায়, চরম সুবিধাভোগ এবং ইন্দ্রিয় আপ্যায়নই এর একমাত্র ল্য ও উদ্দেশ্য। পরিণামে জাতি-সভ্যতাকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হতে প্ররোচিত করে এ আর্ট এবং এতে আকন্ঠ নিমজ্জিত জাতির ধ্বংস ত্বরান্বিত হয়। সামাজিকভাবে একটি জাতি উচ্ছৃংখল, অনাচারে লিপ্ত হয়, মারাতœক ধরণের যৌনরোগের প্রসার এবং নিরপরাধ গরীব শ্রেণী গুটিকয়েক ধনীক শ্রেণীর গোলামে পরিণত এবং চরম নির্যাতনের শিকার হয়। উত্তেজক আর্টের কারিগর-পৃষ্ঠপোষকরা সব সময়ই মতার কাছাকাছি অবস্থান করে এবং জাতির উচু পর্যায়কে স্বেচ্ছাচারিতায় ডুবতে জোর সহায়তা করে।
এই আর্ট যেখানে অবস্থান নিয়েছে, সেখানে সৈসূর্য শিল্প তাকে অনুসরন করেছে এবং বস্তুবাদী দৃষ্টিকোনকে আরো মজবুত করেছে। এটা ললিতকলার অবিচ্ছেদ্য অংশ। যা ক্রমান্বয়ে বাহ্যিকভাবে চাকচিক্য ও তৈলমসৃণ করে কিন্তু অন্তসারশুন্য জাতিতে রুপান্তরিত হয়। মানুষকে তা বস্তুগত ও দৃশ্যমান অবয়বে আত্মলোভী প্রাণীতে পর্যবসিত করে। এ আর্টের শিকারে যে জাতি পড়ে তার কল্যাণময় উদ্দেশ্য মুখ থুবড়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত পূর্ণমাত্রার বস্তুবাদী ও ভোগবাদী মানসিকতায় চালিত হয়। এ আর্টের উত্তেজক আনন্দ ( Sensual Pleasure) শুধুমাত্র ইহজাগতিক তথা পৃথিবীকেন্দ্রিকতা, ধর্মনিরপেতা ও সুবিধাবাদী নীতিকে বরণ করে।
এ আর্টের কবলে পড়ে রোমান জাতি নগ্নমূর্তি চর্চায় ডুবে গিয়েছিল। অন্যদিকে বিশাল পরিমান জাতীয় সম্পদ অল্প সংখ্যক লোকের করায়ত্ত্ব হয়ে তা বিপুল সংখ্যক লোকের দারিদ্রের ওপর অত্যাচারের স্টীমরোলার চালানোর কাজে নিয়োজিত হয়েছিল। এই অসাম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সামান্যতম প্রচেষ্টাকে অমানুষিক নির্যাতন দ্বারা দমন করা হয়েছিল। সেখানে ধর্মীয় ও নৈতিক বিধানের প্রতিটি ধারাকে লংঘন করা হয়েছিল। সে সমাজে যেখানেই মানুষ সততা, দয়ার্দ্রতা, বদান্যতা ও সহানুভূতির পথ অনুসরনের চেষ্টা করেছে, সেখানেই তারা ভোগ করেছে সীমাহীন নির্মমতা। নির্যাতনকারীরা নিজদেরকে গৌরবান্বিত বোধ করেছে, অহংকারের অট্টহাস্যে ফেটে পড়েছে এবং নির্মমতার দীর্ঘ খড়গ অব্যাহত গতিতে চালিয়েছে। কিন্তু সেই জাঁকালো প্রাসাদ তাদের দ্রুত ভেঙ্গে পড়েছে। পুনরায় সেখানে মতা ও সম্পদের লোভ জাতিকে সেই দিকেই চালিত করেছে কারণ উত্তেজক আর্ট মানুষের মজ্জাগত বিষয় হিসেবে গৃহিত হয়েছে।
এই আর্ট পশ্চিমা বিশ্বসহ যেখানে আসন গেড়েছে , সেখানে ইন্দ্রিয় সুখ ও বৈষয়িক সুবিধা একাকীই আধুনিক মানুষের মনের ওপর একচ্ছত্র প্রভূত্ব স্থাপন করেছে আর তা লাভ করার জন্য সে কোন আইনের ধার ধারার প্রয়োজন বোধ করেনি।
এই আর্টের সহোদর হচ্ছে বর্তমান আধুনিক এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট ( Abstract Art) । উত্তেজক আর্টের নিষ্পেষনে পশ্চিমা দুনিয়ায় মানুষ হাঁসফাস করছিল। রাশিয়ার ‘অক্টোবর বিপ্লবের’ পর এ. কে গুস্তাফ এবং তার অনুসারীরা এক ধরণের বিমূর্ত শিল্পকলার উদ্ভাবন করেন। যাকে বলা হয় ‘কনস্ট্রাক্টিভ সিম্বলিক রিপ্রেজেন্টেটিভ আর্ট’ বা গঠনমূলক প্রতিকধর্মী প্রতিনিধিত্বশীল শিল্প। শিল্পকলার ইতিহাসে দেখা যায়, বর্তমানের বিমূর্ত শিল্পকলা ( Abstract Art) মূলত: রাশিয়ার প্রাথমিক বিপ্লবকালীন সময়ের ফসল হিসেবেই অস্তিত্ব লাভ করেছে। এ আর্টের যে তত্ত্ব নিহিত তা হচ্ছে- সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক সিস্টেমের অভিন্নতা ও সংহতি চুর্ণবিচুর্ণ করার জন্য তাতে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সংহতি বিরোধী ভাবধারা ও উপকরণাদি প্রবিষ্ট করিয়ে দিতে হবে। এই তথাকথিত গঠনমূলক নীতির অনুসারী আর্টের ল্যই হচ্ছে প্রাচীন ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত মূল্যমান ও সাংস্কৃতিক জীবনে চরম বিপর্যয় সৃষ্টি করা।
আজ থেকে প্রায় পৌনে একশ বছর আগে রুশবিপ্লবের প্রাথমিককালে বলশেভিকদের দর্শনে যে বিষয়গুলো গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার পেয়েছিল তা হচ্ছে- মেকানিক, কাব্য ও সঙ্গীত, যান্ত্রিক থিয়েটার, যান্ত্রিক প্রতিমূর্তি নির্মাণ এবং সবশেষে যান্ত্রিক মানুষ। আর্টের এই বিভিন্ন মাধ্যমে ( Media) ল্য ছিল প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা সমূহে বিপর্যয় সৃষ্টি করা। বলা বাহুল্য, এই আর্টের অগ্রনায়ক কান্দিনিস্কি আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সংস্থার সদস্য ছিলেন। এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য তাকে মার্কিন মুলুকে পাঠানো হয়েছিল। তিনি নিউইয়র্কে ‘মিউজিয়াম অব মডার্ণ আর্ট’ স্থাপন করেন। এ আর্টের সৌভাগ্য বলতে হবে কারণ কান্দিনিস্কি তার অনেক যোগ্য অনুসারী পেয়েছিলেন। হিটলার একসময় জার্মানি থেকে এ মতাদর্শের শিল্পীদের বহিস্কার করেছিলেন। তারা আমেরিকা গিয়ে আশ্রয় লাভ করেন। ফলে আমেরিকা এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের লীলাভূমিতে পরিণত হয়। এভাবে এ আর্টের সাহায্যে মার্কিন জনগণের মধ্যে ব্যক্তিত্বের বিপর্যয় ( Personality Fragmentation) সৃষ্টির বীজ বপনে সাফল্য লাভ করার পর স্বয়ং রাশিয়া বর্তমানে বাস্তবাদী শিল্পে ( Realistic Art) ফিরে এসেছে।
একটা জাতি বা জনসমষ্টিকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করার অনেকগুলো পন্থা থাকতে পারে। মানবীয় মন ও মগজকে দাসত্বের নিগড়ে বন্দি করার পন্থাও হতে পারে বহুবিধ। কিন্তু মানব মনকে গোলামীর জিঞ্জির পরানোর আধুনিক উপায় হচ্ছে, তাদের সামনে এমন সব নিদর্শন উপস্থাপন করতে হবে আর তাদের চারপাশে এমন একটি দেয়াল তুলতে হবে, যার ফলে তারা বন্দি থেকেই নিয়ম-শৃংখলা পালনের গৌরব বোধ করতে পারে। তাই বর্তমান কালের বিজয়ীরা বিজিতদের সামনে অর্থহীন, উদ্দেশ্যহীন ও দুর্বোধ্য সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্রিয়াকাণ্ডের নিদর্শন পেশ করা এবং তাতে তাদের মুগ্ধ বিমোহিত করে তুলতে পারাকেই যথেষ্ট মনে করে।
কোন একটি জাতিকে নৈরাশ্য হতাশাগ্রস্ত করে দেয়ার জন্য অর্থহীন ও ল্যহীন কর্মকাণ্ডে মশগুল করে দেয়া একটা অত্যন্ত শাণিত ও কার্যকর হাতিয়ার। অস্পষ্টতা এবং ল্যহীনতাই এই কাজকে সার্থক ও সচল করে দিতে পারে। একটি জাতি বা জনগোষ্ঠীকে মানসিক অধ:পতনের নিম্নতম স্তরে পৌছে দেয়ার জন্যে রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব বিশারদরা যে কটি সাংস্কৃতিক উপায়-উপাদান প্রয়োগ করে থাকে এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট সেগুলোর অন্যতম।
এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট মানবীয় আচরণের এমন পন্থা এবং বঞ্চনানুভূতি ও বিশ্লিষ্টতার এমন সব নিদর্শন উপস্থাপন করে, যার পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত হৃদয়াবেগ ও উচ্ছাস সব সুস্থতা ও ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।
শিল্পের ইতিহাসে দেখা যায়, স্বর্গীয় আর্ট ( Divine Art) যে প্রকাশভঙ্গী উপস্থাপন করে তাতে স্রষ্টার প্রকৃত ও বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী দৃশ্যমান হয়। সৃষ্টিরহস্যের কল্যাণময় উপাদান এতে প্রাধান্য পায়। এ আর্ট সযতনে নেতিবাচক, কুৎসিত, হৃদয় কলুষিত উপাদান ও অশ্লীলতা বর্জন করে। সত্য, সুন্দর, কল্যাণ ও মানসিক সুস্থতা এবং দৃঢ়তা এতে প্রাধান্য পায়। মানুষকে পৃথিবীতে স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এ আর্টে স্রষ্টার জয়গান তুলে ধরে। রঙ, রেখার রূপায়ণে স্বচ্ছতা, পবিত্রতা, নির্মল আনন্দ, সুক্ষ্ম হৃদয়াবেগকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। একে ধর্মীয় আর্ট বলে যে একপেশে মন্তব্য অপরপরা করে থাকেন। আসলে জনগণকে এর পূণ্যময় প্রভাব থেকে ফিরিয়ে রাখতেই তারা এ কুটকৌশল করে থাকেন।
এ আর্টের শক্তিশালী ও প্রধান মাধ্যম হচ্ছে ক্যালিগ্রাফি। বিশেষকরে আরবি ক্যালিগ্রাফি সেই প্রাথমিক সময় থেকে যেভাবে উচুস্থান বজায় রেখে চলেছে, তাতে গবেষকগণ একে লিভিং আর্ট বলতে দ্বিধা করছেন না। একটি অতিসাধারণ উদাহরণে আমরা দেখতে পাবো এই আর্টের কল্যাণকর প্রভাব কত প্রবল। ধরা যাক, একটি করে দেয়ালে একটি নগ্ন শিল্পকর্ম ঝোলানো আছে। সেখানে কোন যুবক বা যুবতীর নির্জন শিল্পকর্ম দর্শনে কী অনুভূতি হবে? নপুংষক, বিবেক-বোধহীন কোন মানুষ এখানে শুধু শিল্প সৌন্দর্য দর্শনের কথা বলবেন। অন্যদিকে পবিত্র কুরআনের লিপি সম্বলিত চমৎকার একটি ক্যালিগ্রাফি শিল্প থাকলে ন্যুনতম তাতে পবিত্র ভাব না জাগলেও হঠাৎ খোদাভীতি জেগে উঠতে পারে এই ভেবে, যদি গযব এসে পড়ে! এখানেই এ আর্টের সার্থকতা।
শিল্পের ধারক-বাহকদের এই অতি সাধারণ বিষয়টির দিকে অনুভূতি ফিরে আসলে বাংলাদেশের শিল্পকলা তার কল্যাণময় উদ্দেশ্য ও ল্েয পৌছতে পারবে বলে আশা করা যায়।
লেখকঃ গ্রন্থকার, গবেষক, শিল্পী, ক্যালিগ্রাফার।